দীর্ঘ বিরতির পর ভোটের মাঠে হতে যাচ্ছে নৌকা-ধানের শীষের লড়াই

প্রতীক নিয়ে আজ প্রচারে নামছেন প্রার্থীরা : এমপিরা প্রচারের বাইরেই থাকছেন

স্টাফ রিপোর্টার: দীর্ঘ বিরতির পর ভোটের মাঠে সরাসরি লড়াই হতে যাচ্ছে নৌকা ও ধানের শীষের। অনেক দিন ধরেই দেশের রাজনীতি কথার লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ। এবার ভোটের মাঠে মুখোমুখি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী গাজীপুর ও খুলনা সিটিতে ভোট হবে ১৫ মে। আজ মঙ্গলবার প্রতীক বরাদ্দের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে আনুষ্ঠানিক প্রচার। কমিশনের পক্ষ থেকে আচরণবিধি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হলেও এ দুই সিটির ভোটে মন্ত্রীদের মতোই এমপিরা প্রচারের সুযোগ পাচ্ছেন না। স্থানীয়দের মতে, দুই সিটিতে মেয়র পদে একাধিক প্রার্থী থাকলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর মধ্যে দ্বিমুখী লড়াইয়ের বিষয়টি এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, সিটি ভোটে মেয়র পদে দলীয় প্রতীক বরাদ্দের পর এ পর্যন্ত দুটি সিটিতে ভোট হয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে নৌকা প্রতীক বিজয়ী হলেও কুমিল্লায় ধানের শীষ জিতেছে। তবে গত বছরের শেষে ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশনের ভোট দলীয় প্রতীকে হলেও মূল লড়াইয়ে বিএনপি ছিলো না। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির দ্বিমুখী লড়াইয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়ী হন। এর আগে স্থানীয় সরকারের পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা ও ধানের শীষের লড়াই হলেও বড় পরিসরে গত বছরের ৩০ মার্চ কুমিল্লা সিটি ও ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ সিটির ভোটে মুখোমুখি লড়াই হয়। পাঁচ বছর আগে গাজীপুর ও খুলনা সিটির ভোটে দলীয় প্রতীক ছিলো না। ওই ভোটে জিতে বিএনপি সমর্থিত এম এ মান্নান গাজীপুরে ও মনিরুজ্জামান মনি খুলনায় মেয়র পদে আসীন রয়েছেন।

স্থানীয়  সূত্রগুলো জানিয়েছে, আনুষ্ঠানিক প্রচারে নামতে বড় দু’দলের মেয়র প্রার্থী, কর্মী-সমর্থকসহ কাউন্সিলর প্রার্থীদের অনুসারীরা উন্মুখ হয়ে আছেন। সংসদ নির্বাচনের বছরে দুই সিটির এই ভোট নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও নানা হিসাব-নিকাশ চলছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের আগে এই ভোট কে. এম. নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই ভোটে তাদের ইতিবাচক ভূমিকা প্রকাশ পেলে নির্বাচন নিয়ে জনমনে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। ইসির ব্যর্থতায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনিশ্চয়তা বাড়বে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার অবশ্য বলেছেন, সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করতে ইসির পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আচরণবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে দুই রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভোটের মাঠে ম্যাজিস্ট্রেটরা দায়িত্ব পালন করবেন। কমিশনের পক্ষ থেকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।

সূত্র জানিয়েছে, প্রায় তিনটি সংসদীয় আসনের সাড়ে ১১ লাখ ভোটার নিয়ে গাজীপুর সিটির নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা কম থাকলেও খুলনার চিত্র বিপরীত। এই সিটিতে দুটি সংসদীয় আসনের প্রায় পাঁচ লাখ ভোটার রয়েছেন। প্রচার শুরুর আগেই রোববার রাতে খুলনা নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের শেরেবাংলা রোডে বিএনপির সমর্থিত ওয়ার্ড পর্যায়ের দুই নেতার বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ৩১ মার্চ এ দুই সিটির তফসিল ঘোষণা করা হলেও দুই সিটির ভোটের আমেজ এখন পর্যন্ত ড্রয়িংরুম আর চায়ের দোকানেই সীমাবদ্ধ। প্রতীক বরাদ্দের পর আজ থেকে মাঠের লড়াই বেশ জমে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। এমপিদের প্রচারে নামার সুযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানান, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মন্ত্রী বা এমপিরা প্রচার চালাতে পারবেন না। আচরণ বিধিমালা সংশোধনের বিষয়ে কমিশন সভায় এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। একটি কমিটি করা হয়েছে। যেহেতু আচরণ বিধিমালা সংশোধন হয়নি, তাই মন্ত্রী বা এমপিরা প্রচার চালাতে পারবেন না।

ইসির কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান আইনে আচরণবিধি লঙ্ঘনে ছয় মাসের জেল বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদ উভয় দ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর রাজনৈতিক দল বিধি লঙ্ঘন করলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের দায়ে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাও ইসির হাতে রয়েছে। আইন অনুযায়ী প্রার্থীদের কিছু বিধিনিষেধ মেনে প্রচার চালাতে হবে। প্রার্থীরা কোনো প্রতিষ্ঠানে চাঁদা বা অনুদান দিতে পারবেন না। সার্কিট হাউস, ডাকবাংলোসহ সরকারি স্থাপনা প্রচারকাজে ব্যবহার করা যাবে না। পথসভা বা ঘরোয়া সভা ছাড়া কোনো জনসভা বা শোভাযাত্রা করা যাবে না। পোস্টার ও লিফলেট নির্দিষ্ট আকারের হতে হবে। নির্বাচনী এলাকায় মিছিল বা শোডাউন করা যাবে না। গাজীপুর থেকে ইজাজ আহমেদ মিলন ও আবু সালেহ মুসা জানান, দুই পৌরসভা ও ছয় ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ৫৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে বিভক্ত গাজীপুর সিটির মেয়র প্রার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ ওয়ার্ডে ২৮৭ জন ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ৮৭ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীও আজ থেকে প্রতীক নিয়ে প্রচারে নামছেন। এত দিন নানা কৌশলে প্রার্থীরা প্রচার চালিয়েছেন। এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করেছে ইসি। তবে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে জাহাঙ্গীরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। গাজীপুর রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, আচরণবিধি তদারকিতে ৫৭টি ওয়ার্ডকে ১০টি ভাগে ভাগ করে ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

এই সিটিতে গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে এক লাখ ১০ হাজারের মতো ভোটার বেড়েছে। ভোটকেন্দ্রের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে ৩৩টি। আগে ভোটকেন্দ্র ছিলো ৩৯২টি। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২৫টি। খুলনা থেকে মামুন রেজা ও হাসান হিমালয় জানান, খুলনা সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ইউনুচ আলী সকাল সাড়ে ৯টায় তার কার্যালয়ে প্রথমে পাঁচ মেয়র প্রার্থীকে প্রতীক বরাদ্দ দেবেন। এরপর সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ করা হবে।

প্রতীক বরাদ্দের পর আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক সকাল ১০টায় নগরীর পিকচার প্যালেস মোড় থেকে প্রচার শুরু করবেন। এরপর খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তার নির্বাচনী ওয়েবসাইট উদ্বোধন করা হবে। এরই মধ্যে তার পক্ষে ১২৫ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। সেখানে দলের সব পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

গত রোববার রাতে নগরীর ইউনাইটেড ক্লাবে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের যৌথ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাগেরহাট-১ আসনের সাংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই শেখ হেলাল উদ্দিন দলের প্রার্থীর পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ওই সভায় জেলা সভাপতিকে প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট, নগর কমিটির সহসভাপতি কাজী আমিনুল হককে আহ্বায়ক করে ১২৫ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। অন্যদিকে বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু মা-বাবার কবর জিয়ারতের পর নির্বাচন অফিসে যাবেন প্রতীক বরাদ্দের জন্য। এরপর সকাল সাড়ে ১০টায় দলীয় কার্যালয়ে দোয়া অনুষ্ঠান এবং কার্যালয় চত্বর থেকেই প্রচার শুরু করবেন। তবে তার নিজ দলের মধ্যে মতবিরোধ এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। নগর বিএনপির কোষাধ্যক্ষ আরিফুর রহমান মিঠু ও তার অনুসারীরা এখনও নির্বাচন কাজে সম্পৃক্ত হননি। তাদের সঙ্গে সমঝোতার কোনো চেষ্টাও হয়নি বলে মিঠুর অনুসারীরা অভিযোগ করেছেন।

এ ব্যাপারে নজরুল ইসলাম মঞ্জু জানান, স্থানীয়ভাবে বিরোধ মেটানোর জন্য স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি দু-একদিনের মধ্যে খুলনায় আসবেন। প্রচারণা শুরুর বিষয়ে মঞ্জু বলেন, এরই মধ্যে পোস্টার-লিফলেট সবকিছুর কাজ শেষ হয়েছে। অন্য দলগুলোর মধ্যে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এস এম শফিকুর রহমান মুশফিক বেলা ১১টায় ডাকবাংলো মোড়ের দলীয় কার্যালয় থেকে, ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা মুজাম্মিল হক প্রতীক নেওয়ার পর নির্বাচন অফিস থেকে প্রচার শুরু করবেন। তবে সিপিবির প্রার্থী মিজানুর রহমান বাবু একদিন বিরতি দিয়ে বুধবার বিকেল ৪টায় পিকচার প্যালেস মোড়ের দলীয় কার্যালয় থেকে প্রচার শুরু করবেন।