দাপুটে সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের রাজনীতি

 

স্টাফ রিপোর্টার: এখন সময় সিন্ডিকেটের, সর্বত্রই চলে সিন্ডিকেট সাম্রাজ্য। সরকারি দফতর-অধিদফতর থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, তদবির, গ্রুপিং-লবিং এমনকি অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেটের বিকল্প নেই। সমমনা নেতা-কর্মীদের নিয়ে যেমন সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে তেমনি ধান্ধাবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, লুটপাট চালাতে সরকারি আর বিরোধী দলের নেতারাও মিলেমিশে তৈরি করেন সিন্ডিকেট। সরকারি দফতর-অধিদফতর থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট সদস্যরা গ্রুপিং নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে যা খুশি তা করে বেড়ান। তাদের নিয়ন্ত্রণেই চলে ঘুষ, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি ইত্যাদি অপরাধ-অপকর্ম। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী প্রভাবশালী কয়েকটি সিন্ডিকেটও রয়েছে দেশে, যাদের কাছে অনেক সময় সরকারও অসহায় হয়ে পড়ে। প্রতি বছর রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখার সরকারি উদ্যোগ-আয়োজন সবকিছু এই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ভণ্ডুল হয়ে যায়। আইন-আদালত ঘিরেও রয়েছে আরেক সিন্ডিকেট। ন্যায়নীতির বুলি আওড়িয়ে আভিজাত্য মোড়ানো পোশাক গায়ে জড়িয়ে আইনি জটিলতা তৈরি করে তারা জনহিতকর কর্মকাণ্ডে বাদ সাধেন। ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিল করতে সবকিছুই করতে পারে সিন্ডিকেট। রাজনৈতিক দলের মনোনয়নপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি হতে হলেও সিন্ডিকেটের আশীর্বাদ অপরিহার্য। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীদের মধ্যে যেমন আলাদা সিন্ডিকেট আছে তেমনি সংসদ সদস্যদের মধ্যেও আছে আলাদা মত-পথের সিন্ডিকেট। জেলা পর্যায়েও সংসদ সদস্যরা পৃথক সিন্ডিকেটে বিভক্ত। এক জেলায় পাঁচ সংসদ সদস্যের মধ্যে দুটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, অন্য এক এমপি সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসককে নিয়ে তৈরি করেছেন পৃথক সিন্ডিকেট। মানব পাচার, জনশক্তি রপ্তানি, এমনকি হজে লোক পাঠানোর বিষয়ও নিয়ন্ত্রণ করছে শক্তিশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। নেপথ্যে সিন্ডিকেট সদস্যদের প্রভাবেই দেশজুড়ে দখল-বেদখল-পাল্টা দখলের সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। ক্ষমতার প্রভাব, দলীয় পরিচয়, অস্ত্রের বল আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে চলে দখলবাজির দাপুটে কারবার। সরকারি সম্পত্তি, টেন্ডার থেকে শুরু করে পেশাজীবীদের ক্লাব-সংগঠনও দখলবাজির ধকল থেকে রেহাই পায় না।

দাপুটে সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের রাজনীতি। তাদের ইশারায় ঘটে চলেছে সব ধরনের অপরাধ। খুন-খারাবি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে সংঘাত-সংঘর্ষ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে কোনো না কোনো সিন্ডিকেট। আধিপত্য সৃষ্টি এবং সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটাতেই একেক স্থানে একেকজন নেতা অপরাধের নেপথ্য নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছেন। নারায়ণগঞ্জে গডফাদার-কেন্দ্রিক অপরাধ-অপকর্ম কমে গেলেও ফেনী আর লক্ষ্মীপুরে রাজনৈতিক অপরাধের দৌরাত্ম্য কমছে না। ওই দুটি স্থানে একের পর এক খুন, অপহরণ, গুম, রোমহর্ষক অপরাধ ঘটেই চলেছে। এসব ঘটনায় সম্পৃক্ত খুনি, দুর্বৃত্ত, সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক ছায়াতলেই আশ্রয় নিয়ে বহাল তবিয়তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আবার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দমিয়ে রেখে প্রশাসনিক সিন্ডিকেটের পৃষ্ঠপোষকতায় সীমাহীন অপরাধ ঘটে চলেছে গাজীপুর, ঝিনাইদহ, নরসিংদীসহ কয়েকটি জেলায়।

ঈদ সামনে রেখে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট নানা নামে নানা রকমে শুরু করেছে পরিবহনে চাঁদাবাজি। থানার চাঁদা, ফাঁড়ির চাঁদা, বোবা চাঁদা, ঘাট চাঁদা, স্পট চাঁদা; পুলিশের নজরানা, মালিক-শ্রমিকের কল্যাণ ফি; রুট কমিটি-টার্মিনাল কমিটির চাঁদাও চলে অবাধে। সবকিছুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে পুলিশের টোকেন বাণিজ্য। বাণিজ্যিক পরিবহনে নানা নামে নানা ঢঙে চাঁদাবাজি চলে। চাঁদাবাজির নেপথ্য পরিচালনাকারীদের হাত গলিয়ে চাঁদার টাকা সরাসরি দুই মহাজনের হাতে গিয়ে পৌঁছে। অপরাধজগতের চিহ্নিত গডফাদাররাই এখন স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন, তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরও খবরদারিত্ব করছেন। অপরাধী নেতাদের সিন্ডিকেট প্রভাব খাটিয়ে, চাপ সৃষ্টিসহ যোগসাজশের মাধ্যমে সব কাজ হাসিল করার মতো ক্ষমতাবান মাফিয়ায় পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা নানা অপরাধের পাশাপাশি মাদক ব্যবসার সঙ্গেও সরাসরি সম্পৃক্ত। দেশব্যাপী ইয়াবা ও ফেনসিডিলের হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যের মূলেও রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, এমনকি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও। রাজধানীর বহু থানায় ছাত্রলীগের কতিপয় নেতার তত্ত্বাবধানেও ফেনসিডিল-ইয়াবা বিক্রির ব্যবসা চলে। গুটিবাজির সিন্ডিকেট সাম্রাজ্যও আছে খোদ রাজধানীতেই। মোহাম্মদপুরে সাড়ে ১৭ একর আয়তনের জেনেভা ক্যাম্পে ৪০ হাজার প্রজার বসবাস। সেখানে ছয়জন রাজা সেজে গড়েছেন ইয়াবা সিন্ডিকেট। তারা গুটি কেনাবেচা থেকেই প্রতি মাসে আয় করছেন ২০ কোটি টাকা। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের এ ইয়াবা সাম্রাজ্যকে কেন্দ্র করে এই ক্যাম্পের বাজারে এ পর্যন্ত ২১ জন খুন হয়েছেন।

আন্তর্জাতিক সাত সিন্ডিকেটের সহযোগী হিসেবে দেশি ১৬টি চক্র পরিচালনা করছে সোনা চোরাচালান। এসব চক্রে সরাসরি সম্পৃক্ত বিভিন্ন স্তরের দুই শতাধিক সদস্য। তারা দেশের দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ কয়েকটি পয়েন্টে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী ঘাঁটি। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ছাড়াও অন্তত আটটি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনস কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে তাদের। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ১২ জন পদস্থ কর্মকর্তাসহ অর্ধশতাধিক কর্মী সোনা চোরাচালানে সরাসরি ভূমিকা রাখেন বলে অভিযোগ। অভিযোগ আছে, সিভিল অ্যাভিয়েশনের বেশকিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যও এ সিন্ডিকেটের সক্রিয় কর্মী। বনানীর ধর্ষকাণ্ডে আপন জুয়েলার্সের মালিক গ্রেফতার ও প্রায় ১৫ মণ সোনা জব্দ হলেও পাচার সিন্ডিকেটের অন্য হোতাদের টিকিটিও ছুঁতে পারে না প্রশাসন। যেখানে যার অবস্থান সেখানেই নিজের স্টাইলে সিন্ডিকেট সাজিয়ে বসেছেন কেউ কেউ। সরকারি দফতরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও আলাদা সিন্ডিকেট গড়ে টাকাপয়সা পকেটস্থ করে চলেছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরে সরকার আসে সরকার যায়, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীও বদল হন; কিন্তু আফজাল সিন্ডিকেট বহাল থাকে বছরের পর বছর। তারা গোটা অধিদফতর লুটপুটে খাচ্ছে। তাদের অপরাধ সিন্ডিকেট ভাঙার সাধ্য যেন কারও নেই। ওষুধ প্রশাসনে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে কিবরিয়া-শফিক-মান্নাফের সিন্ডিকেট। এই গ্রুপের অবৈধ চাহিদা না মিটিয়ে সেখানে বৈধ কোনো কাজ করারও সাধ্য নেই কারোর। স্টিকার চাঁদাবাজির আরেক সিন্ডিকেট বেশ সক্রিয়। তারা রাজধানীতে ত্রুটিপূর্ণ কাগজপত্রের সিএনজি ট্যাক্সিতে ‘প্রেস/সংবাদপত্র’ লেখা স্টিকার লাগিয়ে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। দিগন্ত নিউজ অনলাইন টিভি নামের একটি অনুমোদনহীন টিভি চ্যানেলের নামে স্টিকার বানিয়ে অন্তত ৫ হাজার সিএনজি ট্যাক্সিতে বিক্রি করা হয়েছে। সিএনজি চালকরা জানিয়েছেন, প্রতি মাসে ওই টিভির স্টিকার ও চালকের আইডি কার্ড ব্যবহার বাবদ ২ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।