দাদন ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি ঝিনাইদহের কোলা ইউনিয়নের সহস্রাধিক মানুষ

 

ঝিনাইদহ অফিস: কাঁচামালের ব্যবসা করে ভালোই দিন কাটাচ্ছিলেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বরাট গ্রামের আশরাফুল ইসলাম। দু বছর আগে তার স্ত্রী মিনা খাতুন হঠাত অসুস্থ হন। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য মাসে শতকরা ৩০ টাকা সুদে তিনি দু কিস্তিতে ৩০ হাজার টাকা ঋণ করেন। শাদা স্ট্যাম্পে সই করে কালার বাজারের আনছার মণ্ডল ও জাহিদুল ইসলাম নামে দু দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আশরাফুল ওই ঋণ নেন। অভাবের কারণে নির্ধারিত সময় সুদ-আসলে আশরাফুল ওই অর্থ পরিশোধ করতে পারেননি। তাই দাদন ব্যবসায়ীরা তাকে প্রায়ই অপদস্ত করতেন। দাদন ব্যবসায়ীদের এ পর্যন্ত ৪ লাখ ২৮ হাজার টাকা দিয়েও দিনি দেনামুক্ত হতে পারেননি। গত ৭ জুলাই ওই দু দাদন ব্যবসায়ী ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা পাওনা দাবি করে তাকে উকিল নোটিশ দিয়েছেন। সময় বেধে দিয়েছেন এক মাসের। প্রতিনিয়ত দেয়া হচ্ছে হুমকি-ধামকি।

আশরাফুলের মতো দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছেন কালীগঞ্জে উপজেলার কোলা ইউনিয়নের সহস্রাধিক নিম্ন আয়ের মানুষ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোলা ইউনিয়নের বরাট, দামোদরপুর, পান্তাডাঙ্গা, পান্তাপাড়া, রাকড়া, দাসপাড়া, চুকইতলাসহ নিম্ন আয়ের মানুষ নিজেদের জীবন ও জীবিকার জন্য টাকা ধার নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। স্বর্ণালঙ্কার, জমি, স্বাক্ষর করা ব্যাংকের চেক বই ও নন জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প বন্ধক রেখে সুদখোর মহাজনরা অভাবী মানুষদের টাকা দেন। আর্থিক অনটনে ধারকর্য করে পরবর্তীতে দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ টাকা পরিশোধ করেও অনেকেরই মেটেনি দেনার দায়। সুদ ও চক্রবৃদ্ধি সুদের বেড়াজালে এরই মধ্যে ভিটেমাটি হারিয়েছেন অনেকে। কখনো কখনো পাওনা টাকার দোহাই দিয়ে জব্দ করা হচ্ছে ভিটেমাটি অথবা গোয়ালের গরু। দাদন ব্যবসায়ীদের ভয়ে শতাধিক মানুষ আত্মগোপন করে আছেন। টাকা দিতে না পারায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি পরিবার পালিয়ে ভারতে চলে গেছেন। শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত হয়ে অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দিনের পর দিন। আর অসাধু মহাজনদের অত্যাচারের প্রতিকারও মিলছে না কোথাও। টাকা পরিশোধ করতে না পারলে কখনো কখনো অমানবিক নির্যাতন নেমে আসে।

কালার বাজার এলাকায় সুদখোর মহাজনরা এলাকার সহস্রাধিক মানুষের কাছে লাখ লাখ টাকা বিতরণ করেছে। তেঘরিহুদা গ্রামের আনছার মণ্ডল, পল্লি চিকিৎসক জাহিদুল ইসলাম, শাহিনুর মাস্টার, পান্তাপাড়া গ্রামের শফি মোল্লা করছেন দাদন ব্যবসা। ‘চরকা কল’ নাম দিয়ে তারা এলাকায় তিন বছর ধরে দাদন ব্যবসা করে আসছেন। দাদন ব্যবসায়ীরা শতকরা মাসিক ১০ থেকে ১২ টাকা হারে সুদ নিচ্ছেন।

সুদখোর মহাজনদের অত্যাচারে জমিজমা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। তবে বেশির ভাগ লোকই মহাজনদের খপ্পরে পড়ে বছরের পর বছর ঋণগ্রস্তই থাকছেন। কালার বাজারের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম জানান, নানা সমস্যা ও জটিলতার কারণে কৃষকরা সাধারণত ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চায় না। এ সুযোগে এক শ্রেণির দালালরা গ্রাম্য এ দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে যাওয়ার জন্য গরিব কৃষক-শ্রমিকদের উৎসাহিত করে।

রাকড়া গ্রামের ফারুক হোসেন জানান, ২০১২ সালের প্রথম দিকে জাহিদুল ইসলামের ডাক্তারের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিই। চুক্তি ছিলো দিন ১শ টাকা করে ১২ হাজার ৫শ টাকা দিলে পরিশোধ হবে। কিন্তু গত দু বছরে প্রতিদিন ১শ টাকা হারে তাদের দিয়েছি। তারপরও তারা আমার কাছে টাকা দাবি করে যাচ্ছে। তারা আমার বাড়ি এসে বলেছেন, আমার কাছে এখনো ৯০ হাজার টাকা পাবে। টাকা দিতে পারছি না বলে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন। ১৫ দিনের মধ্যে পাওনা টাকা পরিশোধ না করলে মামলা করা হবে। ৬ মাস বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ছিলেন তিনি।

দামোদরপুর গ্রামের সাইদুল ইসলামের স্ত্রী আঙ্গুর বেগম বলেন, আমার চিকিৎসার জন্য দু হাজার টাকা নিয়েছিলাম। গত আট মাসে তাদের ১০ হাজার ৪শটাকা পরিশোধ করেছি। কিন্তু আমার দু হাজার টাকা আজও পরিশোধ হয়নি। পাওনাদার শফি মোল্লা আর আনসার মণ্ডল প্রতিদিন আমার বাড়িতে এসে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তারা উকিল নোটিশও পাঠিয়েছেন। একইভাবে দামোদরপুর গ্রামের নাসির আহমেদের ছেলে আব্দুল মান্নান ২০ হাজার টাকা নেন। গত এক বছরে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা তাদের হাতে তুলে দিলেও এখনো ২৫ হাজার টাকা পাবেন বলে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন।

পার্শ্ববর্তী পিপরোল গ্রামের শরিফুল ইসলাম ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন কালার বাজারের দাদন ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলামের কাছ থেকে। ৪৪ হাজার ২শ টাকা দিয়েও টাকা শোধ হয়নি। ৯০ হাজার টাকা পাওনা দাবি করে তাকেও উকিল নোটিশ দেয়া হয়েছে। ওই দাদন ব্যবসায়ীকে মোট ১৪ জনকে এমন উকিল নোটিশ দিয়েছে। পান্তাডাঙ্গা গ্রামের রাজ্জাক, রাকড়া গ্রামের ইলিয়াস, দামোদরপুর গ্রামের আতর আলী, জমির, রহিম, ঝন্টু মিয়া সুদের জালে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। বরাট গ্রামের অরুন বিশ্বাস ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন।

তবে কালার বাজারের দাদন ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম বলেন, তার বান্ধব সমাজকল্যাণ ফাউন্ডেশন নামে একটি এনজিও রয়েছে। সেখানে সদস্যরা সমিতি করে টাকা লেনদেন করেন। তবে তিনি ওই এনজিও’র অনুমোদনের কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। বাজারে একটি ওষুধের দোকান করে তিনি দীর্ঘদিন ধরে দাদন ব্যবসা করে আসছেন। দাদন ব্যবসায়ী আনসার মণ্ডল জানান, গ্রামের লোকজন প্রয়োজন হলে তাদের কাছ থেকে টাকা নেন। পরে নির্দিষ্ট লাভে পরিশোধ করে দেন। এর মধ্যে অনেকে ইচ্ছা করেই টাকা দেন না। তারাই অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু তাদের নামে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। আর শাহিনুর মাস্টার ও শফি মোল্লা দাদন ব্যবসার কথা অস্বীকার করেছেন।

স্থানীয় কোলা ইউপি চেয়ারম্যান মো. আয়ুব হোসেন জানান, চড়া সুদে টাকা নিয়ে পরিশোধ করতে না পেরে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে ভারতে চলে গেছেন। এদের হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় মানুষের নেই। মূলত এলাকার একটি বিশাল জনগোষ্ঠী দিনমজুরির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। আর দরিদ্র এই জনগোষ্ঠীর নিত্য অভাব অনটনের সুযোগ নিচ্ছেন কিছু অসাধু দাদন ব্যবসায়ী।

দ্রুত এসব ঘটনার তদন্ত শুরুর কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী। কালীগঞ্জ থানার ওসি আনোয়ার হোসেন জানান, অভিযোগ পাওয়ার পরই আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেবো। কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) দেব প্রসাদ জানান, উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ ধরনের অভিযোগ উঠেছিলো। তবে তাদের কাছে এরকম লিখিত কোনো অভিযোগ নেই। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করলে তদন্ত সাপেক্ষে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ানুল আজিম আনার জানান, ভুক্তভোগী নারী-পুরুষরা আমার কাছে মৌখিক অভিযোগ করে গেছে। এরপর বিষয়টি পুলিশ প্রশাসনকে জানিয়ে খোঁজ নিয়ে সত্যতা পাওয়া গেছে। তিনি আরো জানান, দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আগামী এক মাসের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। তা না হলে সুদে কারবারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।