দাউদ ইব্রাহিমের সহযোগীরা ঢাকায়!

স্টাফ রিপোর্টার: আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভারতীয় মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী দাউদ মার্চেন্টকে ফের গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গত সোমবার সন্ধ্যায় গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছিলেন দাউদ মার্চেন্ট। তবে তাকে গ্রেফতারের সময় ও স্থান নিয়ে দু ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। ডিবির কর্মকর্তারা দাবি করছেন, গতকাল মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে দাউদ মার্চেন্টকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, কারাফটকেই দাউদকে হেফাজতে নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে মঙ্গলবার ডিবির কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন দাউদ তাদের হেফাজতে আছেন। সূত্র জানায়, দাউদ মার্চেন্ট দুবাইভিত্তিক ভারতীয় মাফিয়া নেতা দাউদ ইব্রাহীমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ভারতের গুলশান কুমার হত্যা মামলার অন্যতম আসামিকে জামিন পেতে সহযোগিতা করেছে ঢাকায় অবস্থানকারী দাউদ ইব্রাহিমের ঘনিষ্ট সহযোগীরা। ডিবির হাতে আটক না হলে তিনি পাকিস্তান হয়ে দুবাইতে পাড়ি জমাতেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।

ডিবির উপকমিশনার জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্ববর বলেন, সম্প্রতি জামিন পেয়ে কাশিমপুর কারাগারেই ছিলেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি দাউদ মার্চেন্ট। সোমবার সন্ধ্যায় গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে বের হয়ে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। এরপর গোপন খবরের ভিত্তিতে তাকে ৫৪ ধারা আইনে ঢাকার খিলগাঁও এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গাজীপুরে ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমির হোসেন দাবি করেন, কারা ফটকে দাউদ মার্চেন্টেকে আটক করা হয়নি। মার্চেন্ট দীর্ঘদিন কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন। এরপর জামিনের বিষয়টি আগে থেকে জানতে পারিনি। এ কারণে তিনি যখন কারাগার থেকে বের হয়ে যান তখন কারাগারের বাইরে তাদের কেউ দায়িত্বে ছিলেন না।

কাশিমপুর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের-২’র জ্যেষ্ঠ জেল সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত ১৯ নভেম্বর দাউদ মার্চেন্ট আদালত থেকে জামিন পান। এরপর জামিনের কাগজপত্র (নথিপত্র) কারাগারে পৌঁছায় ২৯ নভেম্বর। যাচাই-বাছাই শেষে গত সোমবার সন্ধ্যা ৫টা ৫৫ মিনিটে তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মুম্বাইয়ের সঙ্গীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান টি-সিরিজের স্বত্বাধিকারী গুলশান কুমার ১৯৯৭ সালের ১২ আগস্ট আন্ধেরি এলাকার একটি মন্দির থেকে বেরিয়ে আসার সময় গুলিতে নিহত হন। সঙ্গীত পরিচালক নাদিম সাইফি তাকে হত্যা করার জন্য আবু সালেমকে ভাড়া করেন। অবশেষে আবু সালেমের সহযোগী দাউদ মার্চেন্ট তাকে হত্যা করেন। নাদিম সাইফি বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক যুগল নাদিম-শ্রাবণ এর ঘনিষ্ঠ একজন।

দাউদ মার্চেন্ট ও আবু সালেম দাউদ ইব্রাহিমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। গুলশান কুমার হত্যা মামলায় ২০০১ সালে দাউদ মার্চেন্টকে দশ বছরের কারাদণ্ড দেন ভারতীয় আদালত। এরপর ভারতীয় আইন অনুযায়ী, স্বজনদের সাথে দেখা করার জন্য তাকে ১৫ দিনের জন্য সাময়িক মুক্তি দেয়া হয়। এরপর থেকে মার্চেন্ট মুম্বাই থানায় নিয়মিত হাজিরা দিতেন। কিন্তু এক সপ্তা পরই থানায় রিপোর্ট করা বন্ধ করে দেন। এরপর তিনি দাউদ ইব্রাহিমের সহযোগিতায় পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন। তাকে আশ্রয় দেন ঢাকায় অবস্থানরত মাফিয়া ডন দাউদের কিছু ঘনিষ্ঠ সহযোগী।

ভারত থেকে পালিয়ে ২০০২ সালে বাংলাদেশে এসে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে গ্রেফতার হন মার্চেন্ট। এরপর পাসপোর্ট আইনের মামলায় তিনি জেলে ছিলেন। সেই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেরও অভিযোগ রয়েছে। পাসপোর্ট আইনে একটি মামলাও হয়।

সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, দাউদ অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান করছিলেন। ভারতের অপরাধ জগতের আলোচিত ডন দাউদ ইব্রাহিম বাংলাদেশে নিজের কর্মকাণ্ড বিস্তারের জন্য দাউদ মার্চেন্টকে এ দেশে পাঠান। দাউদ মার্চেন্ট বাংলাদেশে আসার পর ঢাকার মোহাম্মদপুরে জাহিদ নামে আরেক ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে বাসা ভাড়া নেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশি পাসপোর্টও জোগাড় করেন। তার মোবাইলের কল লিস্টে পাকিস্তান ও দুবাইয়ে কথা বলার রেকর্ড মিলে সেসময়।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সম্প্রতি দাউদ ইব্রাহিমের লোকজন দাউদ মার্চেন্টকে জামিনে থাকা অবস্থায় পাকিস্তানে পার করে দিতে চেয়েছিলো। একই সঙ্গে দাউদ ইব্রাহিমের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা ঢাকা থেকে তাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ঠিক রাখছিল। সে সময়, দাউদ মার্চেন্টের সঙ্গে কুখ্যাত মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহীমের ‘যোগাযোগ’ ছিল বলে পুলিশ তার মোবাইল কল লিস্ট পরীক্ষা করে ধারণা পায়।

দাউদ মার্চেন্টকে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় আশ্রয় দেয়া বাড়ির মালিক কামালের স্ত্রী ফেরদৌসী সেসময় পুলিশকে জানান, বাংলাদেশে আসার পরপরই দাউদ মার্চেন্ট তাদের বাসায় ওঠেন। নিজেকে মুজাহিদ নামে পরিচয় দিয়ে ঢাকায় গাড়ির যন্ত্রাংশের ব্যবসা করেন বলে জানান। আখাউড়ার জনৈক বিল্লাল মিয়ার মাধ্যমে তার স্বামী কামালের সঙ্গে মুজাহিদের পরিচয় হয়। মার্চেন্টের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তারা কিছুই জানতেন না।

সূত্রমতে, দাউদ মার্চেন্ট আব্দুর রউফ নামে পরিচিত। মুম্বাইয়ের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণকারী দাউদ ইব্র্রাহিমের পরিবারে তার জন্ম। বেড়ে ওঠার পর থেকেই তিনি অপরাধ জগতের সঙ্গে পরিচিত হন। মুম্বাইয়ের বস্তি থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র, পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করতো দাউদ পরিবার। এর সঙ্গে যুক্ত হন মুম্বাইয়ের অপরাধ জগতের দুই ডন আবু সালেম আর ছোটা শাকিল। শাকিলের নেটওয়ার্ক ভারতের দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা, ব্যাঙ্গালোর, নেপালের কাঠমান্ডু, বাংলাদেশের ঢাকা, পাকিস্তানের করাচি এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশেও বিস্তৃত। অডিও ব্যবসায়ী গুলশান কুমার হত্যার ঘটনায় দাউদ মার্চেন্টের নাম অপরাধ জগতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০১ সালের ৮ জানুয়ারি কলকাতায় ছোটা শাকিলের ঘাঁটি থেকে পুলিশ দাউদ মার্চেন্টকে গ্রেফতার করে।

জিজ্ঞাসাবাদে দাউদ মার্চেন্ট সঙ্গীত পরিচালক গুলশান কুমার হত্যার পুরো ঘটনা স্বীকার করেন। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শিব সেনা ও বলথ্যাকারের সংগঠন আরএসএসকে কোটিপতি গুলশান কুমার আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতেন। তাই দাউদ ইব্রাহিম তখন গুলশান কুমারকে খুন করার পরিকল্পনা নেন বলে ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর বের হয়।