তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ : রক্তাক্ত সংঘাতে নিহত ২৬৫

 

 

মাথাভাঙ্গা মনিটর: জাপানকে যেমন ভূমিকম্প প্রবণ দেশ বলা হয়, তেমনি তুরস্ককে বলা হয় ‘অভ্যুত্থান’ প্রবণ দেশ। তাইতো গত ৫৬ বছরে চুতর্থবারের মতো অভ্যুত্থান ঘটলো গত শুক্রবার রাতে যার জের গতকাল শনিবারও থাকে। তবে প্রতিবারের চেয়ে এবারেরটি ব্যতিক্রম ছিলো। এবার যেভাবে জনগনের বাধায় অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলো তা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। ৩০ বছরেরও বেশি আগে করা অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল। এমনকি সেনাপ্রধানেরও সায় ছিলো না এই বিদ্রোহে। সঙ্গে ছিলো সোশ্যাল মিডিয়া। শুক্রবারের অভ্যুত্থানে নিহত হয় ২৬৫ জন যার মধ্যে অভ্যুত্থাকারী ১০৪ সেনা, পুলিশ ও জনতাসহ নিহত হয়েছে ১৬১ জন। প্রায় তিন হাজার বিদ্রোহীকে আটক করা হয়েছে। বিচারালয়ে অস্থিতিরতার আশঙ্কায় বহু বিচারককে গতকাল কাজ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার করেছেন। তবে সন্দেহের তীর প্রেসিডেন্টেরই এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফেতহুল্লাহ গুলেনের দিকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে এই অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে পাশে থাকার আহবান জানিয়েছেন। খবর বিবিসি, ডেইলি মেইল, ওয়াশিংটন পোস্ট এবং দ্য টেলিগ্রাফের

অভ্যুত্থানের শুরু যেভাবে: শুক্রবার সন্ধ্যায় আকস্মিকভাবে তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুলে সামরিক যান দেখা যায়। এর আগে সেনাবাহিনীর একটি দল দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম টিআরটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। সেনাবাহিনীর দুটি গাড়িতে করে সৈন্যরা সেখানে যায় এবং প্রচার বন্ধ করে দেয়। এরপর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, দেশে অভ্যুত্থান চলছে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার রক্ষায় এই অভ্যুত্থান। দেশ এখন পিস কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণে। দেশে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠন করা হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা সব আন্তর্জাতিক চুক্তি মেনে চলবো এবং বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবো। সবাইকে বাড়ির ভেতর অবস্থানের কথা বলা হয়। সারাদেশের কারফিউ জারি করা হয়। এরই মধ্যে ইস্তাম্বুলের বিমানবন্দর এবং এশিয়া ও ইউরোপের প্রবেশের দরজা হিসেবে খ্যাত ইস্তাম্বুলের বসফরাস প্রণালীর সেতুটির নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনা সদস্যরা। দেশটিতে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক, টুইটার এবং ইউটিউব নানা বাধার সম্মুখীন। তবে এই বাধার মধ্যেও দুটি ইন্টারন্টে মনিটরিং গ্রুপ জানায়, দেশে অভ্যুত্থান চলছে। ইস্তাম্বুলে তখন হাজার হাজার মানুষ। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক সেনা সদস্য এক পথচারীকে বলছেন, এটা অভ্যুত্থান। বাড়ি যান। আর এই খবর শুনে মানুষ এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে শুরু করে। হোটেল এবং দোকান-পাট সব বন্ধ হয়ে যায়। সামরিক বাহিনীর একাংশের বিবৃতির কিছু সময় পরই নতুন বিবৃতি প্রচার করা হয় যাতে বলা হয়, সেনাবাহিনীর একটি দল অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালিয়েছে। তবে সেটি ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তখনো রাজধানী আঙ্কারা এবং ইস্তাম্বুলে সামরিক যানের ছড়াছড়ি। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। অনেক মানুষই কিছু বুঝে উঠতে পারেননি।  আঙ্কারায় গুলির শব্দ শোনা যায়, মাথার ওপর উড়তে থাকে হেলিকপ্টার। পার্লামেন্ট ভবনেও গুলি করা হয় এবং বোমা হামলা চালানো হয়। তিন দফা হামলা চালানো হয় পার্লামেন্ট ভবনে। পুলিশের বিশেষ সদরদফতরও আক্রমণের শিকার হয়।

যেভাবে ব্যর্থহয় অভ্যুত্থান: দুই ঘন্টা সেনাবাহিনী তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। দুই ঘন্টা পর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান টেলিভিশনের পর্দায় আসেন। তবে মোবাইলে তার একটি ভাষণ প্রচার সিএনএন তুর্কি ভাষায় প্রচার করা হয়। তিনি তার সমর্থকদের সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। তিনি স্থানীয় সময় ভোর চারটায় কামার আতাতুর্ক বিমানবন্দরে উপস্থিত হন। এই সময় তাকে ঘিরে তার সমর্থকরা। সেখানে সেনাবাহিনীর সামরিক যানগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সমর্থ হয় তার সমর্থকরা। গত বছরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে তার দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ জনসমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় আসে। তিনি সবাইকে জনসমাবেশের স্থান এবং বিমানবন্দরসহ গুরত্বপূর্ণ স্থানে আসার আহোবান জানান। তিনি বলেন, জনগনের শক্তির চেয়ে দেশে আর কোনো বড় শক্তি নেই। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে। এরদোয়ান ছুটিতে ভূম্যধসাগরীয় তীরবর্তী অবকাশ যাপন কেন্দ্র মারমারিসে ছিলেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসিকে বলেন, তিনি মারমারিসের আকাশে হেলিকপ্টার ঘুরতে দেখেছেন এবং রাতে সেখানে গোলাগুলির শব্দ পেয়েছেন। পরে এক সংবাদ সম্মেলনেও এরদোয়ান জানিয়েছিলেন, শহরটি আক্রমণের শিকার হয়। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতিতে প্রথম দিকে অভ্যুত্থান পরিস্থিতি সামাল দেন।

প্রেসিডেন্টের ডাকে সাড়া দিয়ে রাতে রাস্তায় নেমে আসে তার সমর্থকরা। সেনাবাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষ বাধে। গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। এই অনেকে আহত হয় বলে জানা যায়। সেনাবাহিনীর ট্যাংক থেকে রাস্তায় থাকা গাড়িগুলোর ওপর হামলা চালানো হয়। অনেককে ট্যাংকের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, কেউ বা আবার ট্যাংকের সামনে শুয়ে পড়ে। বসফরাস সেতুর নিয়ন্ত্রণ নেয়া প্রায় শতাধিক সেনা সদস্য আত্মসমর্পন করে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে সেনা সদস্যরা আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে। অনেক ট্যাংকের উপর বিক্ষুব্ধ জনতাকে নাচতে দেখা যায়। অনেক সেনা সদস্যকে একস্থানে জড়ো করে মারধরও করা হয়। একটি হেলিকপ্টার যুদ্ধবিমান দিয়ে ভূপাতিত করা হয়। হেলিকপ্টারটি অভ্যুত্থানকারীরা ছিনতাই করেছিলো বলে জানিয়েছে সরকার। সেনাপ্রধান জেনারেল গুল হুলুসি আকার এই অভ্যুত্থানের সাথে ছিলেন না। সেনাপ্রধান কোথায় এবং কেমন আছেন সেই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে পরে একজন ভারপ্রাপ্ত সেনা প্রধান নিয়োগ দেয়া হয়। সবচেয়ে বড় নগরী ইস্তাম্বুলে ছিলো যে সেনা ডিভিশন, তার অধিনায়কও এই অভ্যুত্থান সমর্থন করেননি। নৌবাহিনী প্রধান এবং বিশেষ বাহিনীর প্রধানও অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেন। এফ-সিক্সটিন জঙ্গি বিমান থেকে অভ্যুত্থানকারীদের অবস্থানে বিমান হামলাও চালানো হয়। ব্রিটেনের একটি থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউজের ফাদি হাকুরা বলেন, এই অভ্যুত্থান আসলে শুরু হওয়ার আগেই ব্যর্থ হয়। এদের পেছনে না ছিলো রাজনৈতিক সমর্থন, না ছিলো জনগণের সমর্থন। তুরস্কের প্রধান দলগুলো শুরুতেই জানিয়ে দেওয়া তারা এর সঙ্গে নেই। ধর্মনিরপেক্ষ সিএইচপি, জাতীয়তাবাদী দল এমএইচপি সবাই সরকারকে সমর্থন জানায়। তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ওমের সেলিক জানান, পরিস্থিতি এখন ৯০ শতাংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে। তবে এখনো কয়েকজন সেনা অধিনায়ক অভ্যুত্থানের পক্ষের সেনাদের হাতে জিম্মি হয়ে আছেন। গ্রিসের পুলিশ মন্ত্রনালয় জানায়, আটজনের একটি হেলিকপ্টার গতকাল সকালে সেখানে অবতরণ করে। তারা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কিন্তু সেই দাবি নাকচ করা হয়। সরকার জানায়, সম্ভবত এরা ক্যু এর সঙ্গে জড়িত সিনিয়র কর্মকর্তা।

কেন এই অভ্যুত্থান: তুরস্কের সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, তারা দেশে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে চায়। তারা মনে করে, এরদোয়ান সরকার সেই ধর্মনিরপেক্ষ সরকার থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। ক্রমেই এরদোয়ার সরকার ধর্মীয় কট্টরপন্থার দিকে যাচ্ছে। এরদোয়ান এর জবাবে বলেন, তার সরকার ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, কট্টরপন্থায় নয়। তুরস্কের মানবাধিকার পরিস্থিরি অবনিতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করে আসছে। এমনকি সরকারবিরোধী দলগুলোর ওপর নিপীড়ন এবং নির্যাতনের জন্য তুরস্কের পশ্চিমা মিত্ররাও নিন্দা জানিয়ে আসছিলেন। গত ১৩ বছরের শাসনামলে এরদোয়ানের শত্রু সৃষ্টি হয়েছে অনেক। শত শত সেনা অফিসারকে আটক করা হয়েছে এবং চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, সেনাবাহিনীর একটি অংশ এই অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে। ইস্তাম্বুলেই মূলত তাদের ঘাঁটি। ফাদি হাকুরা মনে করেন, এরা সেনাবাহিনীর বিরাট অংশের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাদের ব্যর্থতা এটাও প্রমাণ করে যে তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থানের পক্ষে আর সমাজের বেশিরভাগ অংশের কোন সমর্থন নেই। এরদোয়ান এর আগে বহুবার সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তার সরকার সেনাবাহিনীর মধ্যে অনেক শুদ্ধি অভিযানও চালিয়েছে। অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত বলে যার দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে, তিনি হচ্ছে গুলেন। এছাড়া কর্ণেল মুহাররেম কোসে এই অভ্যুত্থানে দেশ থেকে নেতৃত্ব দেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্প্রতি গুলেনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় চাকরিচ্যুত করা হয়। সূত্র জানিয়েছে, এরদোয়ান সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে মুহাররেম মারা গেছেন।

প্রতিশোধের অঙ্গীকার এরদোয়ানের: প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গতকাল এক টুইটার বার্তায় সমর্থকদের সারারাত রাস্তায় থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তিনি অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার করেন। তিনি দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় বসবাসরত ফেতহুল্লা গুলেনইএর পেছনে দায়ী। তিনি অনেকদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছিলেন, দেশে সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করা হচ্ছে এবং তাকে হত্যার করার চেষ্টা চলছে। তিনি রাষ্টদ্রোহ অপরাধে জড়িতদের বিচার করা হবে বলে জানান। অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২ হাজার ৮৬৩ জনকে আটক করা হয়। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এক বিবৃতিতে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার নিন্দা জানিয়েছে। দেশটি গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।