তীব্র খরায় পুড়ছে ক্ষেত : ঝরছে প্রাণ

 

বৃষ্টির জন্য মেহেরপুরে এস্তেসকার নামাজ আদায় : চুয়াডাঙ্গায় বুধবার

 

মাথাভাঙ্গা ডেস্ক: চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় তীব্র তাপপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। গতকালও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। বৃষ্টির জন্য গতকাল মেহেরপুরে এস্তেস্কার নামাজ আদায় করেছেন স্থানীয় মুসল্লিরা। চুয়াডাঙ্গায় আগামীকাল বুধবার এস্তেসকার নামজের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা ওলামা পরিষদ।

ভ্যাপসা গরমে জনজীবনে নেমে এসেছে স্থবিরতা। প্রচণ্ড তাপদাহে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি বয়স্ক লোকসহ শিশুরা অসহায় হয়ে পড়েছে।জরুরি প্রয়োজন না থাকলে তীব্র ক্ষরায় তেমন কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। চিকিৎসকেরা বেশি বেশি পানি ও পানিজাতীয় পানের পাশাপাশি স্যালাইন খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।গতকাল সোমবার মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের চাঁদবিল গ্রামের মৃত পাতানের ছেলে হাসেম আলী (৬০) দর্জি বেলা ১০টার দিকে প্রচণ্ড তাবদাহে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। সোমবার মাগরিব নামাজের পর নামাজের জানাজা শেষে চাঁদবিল কবরস্থানে তার দাফনকাজ সম্পন্ন হয়।

প্রচণ্ড তাপদাহে সারাদেশের মতো মেহেরপুরেরপ্রার্ণীকূল ওষ্টাগত। গ্রীষ্মে শুরু থেকে খরতাপ বাড়লেও বৃষ্টির দেখা নেই।তাই বৃষ্টির আশায় মেহেরপুরের মানুষ এস্তেস্কার নামাজ আদায় করেছেন। সোমবারদুপুরে মেহেরপুর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শ শ মুসল্লি নামাজে অংশগ্রহণ করেন। ঈমামতি করেন মেহেরপুর পৌর ঈমাম সমিতির সভাপতি মাওলানা জহিরুলইসলাম। নামাজ শেষে আল্লাহর দরবারে বিশেষ মোনাজাতের মাধ্যমে বৃষ্টি কামনাকরা হয়। দোয়া মোনাজাত পরিচালনা করেন মেহেরপুর দারুলউলুম আহমেদীয় মাদরাসার অধ্যক্ষ আলহাজ্জ সিদ্দিকুর রহরমান।

এদিকে চুয়াডাঙ্গা জেলা ওলামা পরিষদেরে নেতৃবৃন্দ গতকাল এক সভায় মিলিত হন। পরিষদের সেক্রেটারি মুফতি মুস্তফা কামাল কাসেমি সভার সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী বুধবার সকাল ১০টায় সরকারি মহিলা কলেজ সংলগ্ন মাঠে ও পর্যায়ক্রমে বেলগাছি ঈদগা ময়দানসহ শহীদ হাসান চত্বরে এ নামজ আদায় করা হবে বলে এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
দামুড়হুদা অফিস জানিয়েছে, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানি চিনিকল এলাকায় প্রচণ্ড খরা আর তাপদাহে জমির আখ শুকিয়ে যাচ্ছে। বিরুপ আবহাওয়ার কারণে আখচাষ প্রক্রিয়া মারাত্মক হুমকির পড়েছে। আগামী এক সপ্তার মধ্যে পর্যাপ্ত বৃষ্টিনা হলে এলাকার একমাত্র অর্থকরী ফসল আখের অপুরণীয় ক্ষতির আশঙ্কায় শঙ্কিত চাষিরা। সেচ দিয়েও আখ রক্ষা করা দূরহ হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ অনাবৃষ্টি ও প্রচণ্ড তাপদাহে একদিকে যেমন আখ শুকিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে পোকামাকড়ের প্রকোপ বেড়ে গেছে।

চিনিকল কতৃপক্ষসূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০১৩-১৪ রোপণ মরসুমে ৯ হাজার ২৫ একর জমিতে আখ রোপণ করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ৩ দফায় বৃষ্টি হওয়ার কারণে চারা আখের অবস্থা ভালো ছিলো। বৃষ্টি না হওয়ার কারণে তথা দীর্ঘ খরার কারণে আখ শুকিয়ে যাচ্ছে। সেইসাথে পোকামাকড়ের উপদ্রুব ও বেড়ে গেছে। চিনিকলের কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল আখ রক্ষায় পানিসেচের জন্য চাষিদের পরামর্শ দিচ্ছেন। আখের জমিতে পানিসেচ দেয়া ব্যয় বহুল হওয়ায় অনেক চাষিই সেচ দিতে আগ্রহী হচ্ছেনা। সেজন্য সেচ দিতে চিনিকলের পক্ষ থেকে চাষিদের মধ্যে ঋণ হিসেবে অর্থ বিতরণ করা হচ্ছে। এতে চাষিদের আখ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেক চাষিই সেচ বাবদ ঋণ গ্রহণ করছেন না।চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে মে মাসের ১৪ তারিখ পর্যন্ত মাত্র ৫দিনে ৬ দশমিক ৪১ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে ৩ দিনে ৪ দশমিক ৫০ ইঞ্চি, মার্চ মাসে ১ দিনে ১ দশমিক ৬৯ ইঞ্চি এবং ৭ মে শূন্য দশমিক ২২ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় বলে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির চিনিকলসূত্রে জানা গেছে।

অপরদিকে গত বছরের একই সময় ১৯ দিনে ১৬ দশমিক ২৬ ইঞ্চি বৃষ্টি হয়েছিলো। এতে আখের ফলন আশানুরুপ হওয়ায় চাষিরা অধিকতর লাভবান হয়েছিলো।কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষিবিদ আজিজুর রহমান জানান, খরা দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে আখের কুশি বের হচ্ছেনা এবং আখের বৃদ্ধি বিঘ্নিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় পরিস্থিতি মোকাবেলায় চাষিদের পর্যাপ্ত সেচ দিতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তবে অনেক চাষিই এ বাড়তি ব্যয়ের কারণে সেচ দিতে পারছে না।উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দর্শনা কেরু চিনিকল জোন এলাকার আখ উৎপাদন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় আখচাষিরা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন,তেমনি আগামী মরসুমে কাঙ্ক্ষিত আখের অভাবে চিনিকলটিতে চিনি উৎপাদনের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা বির্পযয়ের মুখে পড়বে। সেইসাথে চাষিদের মধ্যে উপকরণ বাবদ বিনিয়োগকৃত প্রায় ৫কোটি টাকার ইক্ষু ঋণ আদায়ও অনিশ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে,বৈরি আবহাওয়ার কারণে এবছর পাট নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মেহেরপুরের পাটচাষিরা। বৈশাখ পার হয়ে জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম সপ্তা পর্যন্ত মেহেরপুরে বৃষ্টির দেখা মেলেনি। রৌদ্র আর খরা-তাপে পাটের চারা গাছ পুড়ে যাচ্ছে। বাড়তি খরচ করে জমিতে পানি সেচ দিয়েও বৃষ্টির পানির মতো পাটগাছের চেহারা ফিরছেনা বলে হতাশায় ভুগছেন জেলার পাটচাষিরা। পাটের পাশাপাশি মরসুমী ফসল নিয়েও বিপাকে পড়েছেন জেলার চাষিরা।পাট উৎপাদনখ্যাত জেলা মেহেরপুর। পাটের ফলন ও দাম পাওয়ার ওপর ভাগ্য বদলায় এ জেলার চাষিদের। তবে বৈরি আবহাওয়ার কারণে এবছর জেলার কৃষকদের মাথায় হাত উঠেছে। লাভের মুখ দেখা হবেনা জেনেও খরচ তুলতে তারা এখনও বৃষ্টির পানির দিকে তাকিয়ে আছেন। এরই মধ্যে তাদের অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। বৈশাখের পর জৈষ্ঠ মাসের ৫ দিন গত হলো। তারপরও মেহেরপুরে বৃষ্টির পানির দেখা মেলেনি। এতোদিনে চাষিরা পাটক্ষেতে সেচ দিয়ে এসেছেন। আর কতো?এখন তাদের সব আশা ফুরিয়ে যেতে বসেছে। মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের হিসাব মতে, এবছর জেলায় ২৩ হাজার ৩১৪ হেক্টর জমিতে পাটচাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়। এপর্যন্ত ২৩ হাজার ২২৫ হেক্টর জমিতে পাটচাষ হয়েছে। কৃষি বিভাগের মতে এবছরও পাটচাষের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এবছর আবহাওয়া বিমুখ হওয়ায় চাষিরা ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত জমিতে পাটচাষ করেননি। কৃষি বিভাগ আরো জানায়, বৃষ্টির অভাবে শুধু ক্ষেতের পাটই পুড়ছেনাক্ষেতের চিচিঙ্গা, পুঁইশাক, পটোল, ঢেঁড়স, পেঁপেসহ মরসুমী ফসল পুড়ছে। বর্তমান সময়ে ক্ষেতের ফসল নিয়ে চাষিদের পাশাপাশি কৃষি বিভাগও উদ্বিঘ্ন।

মেহেরপুর দীঘিরপাড়া গ্রামের একই গ্রামের পাটচাষি আকছার আলী জানান, বৃষ্টির অভাবে এবছর রেকর্ড পরিমাণ সেচ দিতে হচ্ছে। পাটক্ষেতে সপ্তায় একবার সেচ দিতে হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সপ্তায় দুবারও সেচ দিতে হচ্ছে। গত ৫ সপ্তায় এজেলার চাষিদের পাটক্ষেতে পানি সেচ দিতে কি পরিমাণ খরচ করতে হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। বৃষ্টির দেখা মিলবে মিলবে করে তারা সেচ বাবদ এতো খরচ করেছে। এখন লাভের আশা ছেড়ে খরচ উঠবে কি-না তা নিয়ে চিন্তিত জেলার চাষিরা।

শহরের নতুনপাড়ার সজল জানান, তিনি নিজে, তার পিতা ও চাচা মিলে ৩ জনে মোট ৮ বিঘা জমিতে পাটচাষ করেছেন। বৃষ্টি না হওয়ায় তারা চিন্তিত। গেলো বৈশাখ মাসে তারা ক্ষেতে ৪ বার সেচ দিয়েছেন। আর পোকা দমনে দু বার কীটনাশক প্রয়োগ করেছেন। সজল আরো জানান, নিজের শ্যালোমেশিন দিয়ে প্রতিবিঘা জমিতে একবার পানি সেচ দিতে খরচ হয় ৪শটাকা। আর অন্যের শ্যালোমেশিন দিয়ে প্রতি বিঘা জমিতে একবার সেচ দিতে ৫শটাকা খরচ করতে হয়। এছাড়া এক বিঘা জমিতে একবার কীটনাশক প্রযোগ করতে খরচ হয় সাড়ে ৪শ’ টাকা।অনেকে বললেন, বৃষ্টির অভাবে এ মরসুমের পাটচাষিদের কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। চাষিরা একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের উঠে দাঁড়াতে বেগ পেতে হবে মনে করেন তারা।

এদিকে আবহাওয়া অধিদফতর গতকালও চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরের জন্য তেমন সুখকর পূর্বাভাস দিতে পারেনি। বলেছে, হিমালয়ের পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি পশ্চিমা লঘুচাপ অবস্থান করছে যার বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে।পাবনা, বগুড়া, যশোর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলসহ ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে এবং দেশের অন্যত্র আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। যশোর ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলসমূহের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং খুলনা, সাতক্ষীরা, রাজশাহী, ঈশ্বরদী, টাঙ্গাইল, ঢাকা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, মাইজদী র্কোট ও ফেনী অঞ্চলসমূহের ওপর দিয়ে মাঝারি থেকে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।