তিনটি বেসরকারি ব্যাংকে মেজর আরিফের অর্ধশত কোটি টাকা

 

মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে দুটি বিলাশবহুল ফ্লাট : গফরগাওয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি

 

স্টাফ রিপোর্টার: কতোটা অবৈধ আয় না থাকলে ব্যাংকে অতো টাকা গচ্ছিত হয়? র‌্যাবেরসাবেক কর্মকর্তা মেজর আরিফ ও তার দু আত্মীয়ের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিকলেনদেনের তথ্য পাওয়ার পর এরকমই প্রশ্ন উঠেছে। তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের হিসাবে আরিফের অর্ধশতকোটির বেশি টাকা জমা রয়েছে বলেও তথ্য পেয়েছে তদন্ত কর্মকর্তারা।

রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএস এবং মোহাম্মদপুরেদুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের সন্ধানও এখন তদন্ত কর্তাদের কাছে।সেনাকর্মকর্তার হিসাবে এতো টাকার উৎস সম্পর্কে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারছেন নামেজর আরিফ। বিলাসবহুল ফ্ল্যাট সম্পর্কেও কিছু বলছেন না। এ সংক্রান্ত প্রশ্নবারবার এড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। নারায়ণগঞ্জে সাত অপহরণ ও খুনের মামলায়রিমান্ডে আছেন সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা।

টাকার উৎস সম্পর্কে আরিফ নানাধরনের কথা বলছেন। একবার বলেন, কয়েক মাস আগে কিছু জমি বিক্রি করেছি। সেখানথেকে পাওয়া মোটা অংকের টাকা ব্যাংকে রয়েছে। তবে কোন এলাকায় জমি বিক্রিকরেছেন সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে তিনি কিছু জানাতে পারেননি। গত বছরের আগস্টএবং চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মিরপুর ডিওএইচএসএলাকায় কেনা ফ্ল্যাটের ব্যাপারেও সন্তোষজনক কোনো জবাব দেননি সাবেক এই মেজর।

তদন্তকর্মকর্তারা মনে করছেন, সাত খুনের ঘটনায় মোটা অংকের টাকা লেনদেনের যেঅভিযোগ করা হচ্ছে তার বড় একটি অংশ মেজর আরিফের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমাহয়েছে। ঘটনা প্রমাণে এটি বড় সহায়ক হিসেবেও কাজ করবে। এছাড়া মেজর আরিফেরনামে কেনা দুটি ফ্ল্যাটের ব্যাপারেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গ্রামেরবাড়িতে নামে-বেনামে কেনা সম্পত্তি সম্পর্কেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

তদন্তকর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহের গফরগাঁওয় পৌর শহরের ৯নং ওয়ার্ডেরশিলাসীতে মেজর আরিফের গ্রামের বাড়ি। সেখানেও তার নামে-বেনামে রয়েছে বিশালসম্পত্তি। শিলাসী গ্রামের রেললাইনের পূর্বপাশে রয়েছে তার বিলাসবহুল একটিবাড়ি। বাড়িটি দ্বিতীয় তলার নির্মাণ কাজ চলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একনির্মাণ শ্রমিক জানান, র‌্যাবের সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা আরিফ হোসেনেরপূর্বের বাড়ি ছিলো গাজীপুর জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলায়।

গফরগাঁও উপজেলারপৌর শহরের ৯নং ওয়ার্ডের শিলাসী গ্রাম তার নানার বাড়ি। ১/১১-এর সময় মেজরআরিফ যৌথবাহিনীর ইনচার্জ হিসেবে গাজীপুর জেলার দায়িত্বে ছিলেন। ১/১১-তেগাজীপুর জেলায় যৌথবাহিনীর ইনচার্জের দায়িত্ব পালনকালে বিশাল অর্থবিত্তেরমালিক হয়েছেন এ সেনা কর্মকর্তা। সম্প্রতি পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্র কলেজরোডের খায়রুল্লাহ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিপরীতে (ক্ষণিকা) সোহরাবহোসেনের কাছ থেকে ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকায় ১৩ শতাংশ জমি কিনে আলোচনায় আসেন এইমেজর। চরশিলাসী মৌজায় মেজর আরিফ তার মা এবং ছোট ভাইয়ের নামেও কিনেছেন প্রায়কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি। এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেছেন তদন্তকর্মকর্তারা। পর্যায়ক্রমে আরিফকে তার সম্পত্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করাহবে।

এদিকে দু দফা রিমান্ড শেষে ফের ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছের‌্যাব-১১ এর আদমজী ক্যাম্পের সাবেক ইনচার্জ লে. কমান্ডার এমএম রানাকে।রিমান্ড শেষে সোমবার বিকেলে তাকে নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকেএম মহিউদ্দিনের আদালতে হাজির করে ফের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন জানায়মামলার তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। শুনানি শেষে আদালত তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আদালতে শুনানির সময় বরাবরের মতো র‌্যাবকর্মকর্তার পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়াননি। এ সময় আদালতে এমএম রানাকে কিছুবলার আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, নূর হোসেনকে তিনি কোনোদিনই চিনতেননা। অপহরণের স্থান তার দায়িত্বে থাকা এলাকার মধ্যে ছিলো না দাবি করে এমএমরানা বলেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার।
চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তাজেলা গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর মামুন উর রশিদ বলেছেন, সাবেকতিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে রিমান্ডে এনে অব্যাহত জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্যইপাওয়া গেছে। তবে এদের কাছ থেকে মামলায় সহায়ক তথ্য আদায় করা কঠিন কাজ। তাদেরকাছ থেকে পাওয়া গত কয়েক দিনের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

এদিকেরিমান্ডে থাকা র‌্যাব-১১’র সাবেক অপর দু কর্মকর্তা লে. কর্নেল তারেক সাঈদমোহাম্মদ ও লে. কমান্ডার এমএম রানা ঘটনার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথাস্বীকার করলেও হত্যাকাণ্ডের সব দায় চাপাচ্ছেন মেজর আরিফের ওপর। তারা তদন্তকর্মকর্তাদের বারবার বলেছেন, এ ব্যাপারে মেজর আরিফ সব কিছু জানেন। আর মেজরআরিফ বলছেন, ‘আমি অর্ডার ফলো করেছি মাত্র।’ তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রটি আরওবলেছে, মেজর আরিফের সাথে নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে।আরিফ নিজে একজন মাদকাসক্ত ছিলেন, তিনি নিয়মিত ইয়াবা সেবন করতেন। নূর হোসেনপ্রতিদিনই লোক মারফত তার কাছে ইয়াবা পৌঁছে দিতেন।

ওই সূত্র জানিয়েছে, মেজরআরিফ জিজ্ঞাসাবাদেও একটি পর্যায়ে মাদক সেবনের বিষয়টি তদন্ত দলের কাছেস্বীকার করেছেন। এছাড়া কাঁচপুর ব্রিজের নিচে বিআইডব্লিউটিএ’র ডাম্পিংস্টেশনে নূর হোসেনের রংমহলে প্রায় প্রতি রাতেই যেতেন মেজর আরিফ। গভীর রাতপর্যন্ত তিনি ওই রংমহলেই কাটাতেন। নূর হোসেনের কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটাঅংকের মাসোহারা নেয়ার তথ্য-প্রমাণও এখন তদন্ত কর্মকর্তাদের হাতে রয়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র বলেছে, গত কয়েক দিনে তারা চাঞ্চল্যকর বেশ কিছুতথ্য পেয়েছেন। এর মধ্যে হত্যার পর লাশগুলো নদীতে ফেলার জন্য কাঁচপুরব্রিজের নিচে শান বাঁধানো ঘাট দিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উঠানো হয় বলে তারাজানতে পেরেছেন। ওই রাতে ঘাটের আশপাশে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী দুজনের বক্তব্যেএমন তথ্য পেয়েছে তদন্ত কর্তৃপক্ষ।

প্রত্যক্ষদর্শী ওই দু ব্যক্তি পুলিশকেবলেছেন, ২৭ এপ্রিল রাত দেড়টার দিকে তারা কয়েকজন লোককে ইঞ্জিনচালিত একটিনৌকায় কিছু বস্তা উঠাতে দেখেছেন। ছোট্ট একটি পিকআপ ভ্যানে করে ওই বস্তাগুলোঘাটে আনা হয়েছিলো। তবে ওই বস্তায় কি ছিলো তা তারা জানেন না।

২৭ এপ্রিলনারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে র‌্যাব সদস্য পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় নারায়ণগঞ্জসিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহসাতজনকে। ৩০ এপ্রিল ও ১ মে ইটের বস্তা দিয়ে বাঁধা তাদের লাশ ভেসে ওঠেশীতলক্ষ্যা নদীতে। লোমহর্ষক এ ঘটনার পর র‌্যাব-১১ এর কমান্ডিং অফিসার লে.কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, একই ব্যাটালিয়নের দ্বিতীয় অধিনায়ক মেজর আরিফহোসেন এবং সিদ্ধিরগঞ্জ ক্যাম্প কমান্ডার নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার এমএম রানারদিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর।

৬ কোটি টাকারবিনিময়ে র‌্যাবের ওই কর্মকর্তারা নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণের পর হত্যা করেছেবলে অভিযোগ করা হয়। এরপর ওই তিন কর্মকর্তাকে প্রথম নিজ-নিজ বাহিনীতে ফেরতনেয়া হয়। পরে দু সেনা কর্মকর্তাকে অকালীন অবসর এবং নৌ কর্মকর্তাকেবাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। হাইকোর্টে একটি রিট পিটশনের পর আদালত আলোচিত এমামলায় তিনজনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন।