তারেক রহমানের বক্তব্যে রাজনীতিতে ঝড়

 

স্টাফ রিপোর্টার: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যে রাজনীতিতে ঝড় উঠেছে। সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে দলটির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে তারেকের বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদে সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
তারা অভিযোগ করেন, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিকৃত বক্তব্য দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান সংবিধান ও আইনের লঙ্ঘন করেছেন। এই বক্তব্যকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধের শামিল আখ্যা দিয়ে খালেদা-তারেকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জোরাল দাবি তুলে ধরে তারা বলেন, প্রয়োজনে নতুন আইন করে এর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতিহাস বিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া না হলে ভবিষ্যতে জাতিকে পস্তাতে হবে।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের বৈঠকে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সাধারণ আলোচনার শেষ দিনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সরকারি দলের এমপিরা আরো বলেন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ইতিহাস বিকৃত করে সংবিধান লঙ্ঘন ও রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ করেছেন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও দেশের স্বার্থে অবশ্যই মা-ছেলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। একাত্তর ও পঁচাত্তরের ঘাতক, জঙ্গি-সাম্প্রদায়িক অপশক্তি বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তারা। সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার পিতা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক ও দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবি করে বক্তব্য দিলে তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলটির অনেক নেতাও একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন। সর্বশেষ বুধবার তারেক রহমান লন্ডনের আরেক সভায় বঙ্গবন্ধুকে দেশের প্রথম অবৈধ প্রধানমন্ত্রী’ আখ্যা দিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।

গতকাল বিকেলে সংসদ অধিবেশনে এসব বক্তব্যের বিরুদ্ধেই সোচ্চার হয়ে ওঠেন সরকারি দলের জ্যেষ্ঠ এমপিরা। এদিন স্পিকার ড. শিরিন শারমীন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন সরকারি দলের জ্যেষ্ঠ নেতা সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, হুইপ আতিউর রহমান আতিক এবং সাগুফতা ইয়াসমীন এমিলি। সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু- এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে নয় মাসে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামে, প্রথম সরকার গঠিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। কোন অর্বাচীন কী বললো তাতে কিছু এসে যাবে না।

তিনি বলেন, তারা এগিয়ে যাচ্ছেন, এদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু স্বাধীন দেশকে ধ্বংসের জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্র চলছে। কেবল এদের মোকাবেলাই নয়, পরাজিত করেই দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। কোনো অশুভই আর আটকাতে পারবে না তাদের। এ কথা প্রমাণ হয়েছিলো একাত্তরে, প্রমাণ হবে আবারো। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইতিহাসের মীমাংসিত বিষয় নিয়ে আবারো বিতর্ক তোলা হচ্ছে। আজ যেসব অর্বাচীন এই বিতর্ক তুলছে, তাদের নাম মুখে নিয়ে নিজেকে ছোট করতে চান না।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবেই। আর পাকিস্তানে তাকে বিদায় জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো। অথচ একটি অর্বাচীন ছেলে আজ কী বলে! বেয়াদবির একটা সীমা আছে। মায়ের সঙ্গে সে (তারেক) তো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যান্টনমেন্টে ছিল। মা (খালেদা জিয়া) মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, আর তারেক তো কোলের শিশু।

প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির জনক, স্বাধীনতার ঘোষক ও প্রথম রাষ্ট্রপতি- এটা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি। এটা যে অস্বীকার করবে সে সংবিধান লঙ্ঘন করবে। তারেক রহমানের বিতর্কিত মন্তব্য সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি শুধু একটি অর্ধশিক্ষিত যুবকের প্রলাপ নয়। এর পেছনে সুগভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে। বিএনপি-জামায়াত-শিবির চক্র এদেশকে পাকিস্তানে ফেরত নিতে চায়। লন্ডনে আইএসআই যা শিখিয়ে দিচ্ছে, তারেক রহমান তাই বলছে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কটূক্তি করলে বর্তমান সংবিধানেই সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি বলেন, অশিক্ষিত খালেদা জিয়া ও অর্ধশিক্ষিত তারেক রহমান রাষ্ট্রদ্রোহীতা অভিযোগে অভিযুক্ত। রাষ্ট্রের স্বার্থে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া না হলে জাতিকে একদিন চরম খেসারত দিতে হতে পারে। রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি থেকে এসব করছে। জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে আইনগত ও রাজনৈতিক লড়াই শুরু করতে হবে। বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশকে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানমুক্ত জঙ্গিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে পরিকল্পিতভাবে হামলা করছে। এতে সংখ্যালঘুরা নীরবে দেশত্যাগ করছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুপাত ১৩ থেকে ৮ ভাগে নেমে এসেছে। এটা উদ্বেগজনকই নয়, ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র। এসব বন্ধ করতে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, নির্বাচন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হলেও বিএনপির চক্রান্ত শেষ হয়নি। সংবিধানিকভাবে মীমাংসিত বিষয়কে বিতর্কিত করতে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। বিএনপির কেন্দ্র থেকে থানা পর্যন্ত নেতৃত্বে আছেন মুসলিম লীগের সন্তানরা, যারা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। বিএনপি এখন কোণঠাসা ও সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। চন্দ্র-সূর্যের মতো সত্যে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রপতি, আর বঙ্গবন্ধুর হত্যার খলনায়ক হচ্ছেন জিয়াউর রহমান। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে হত্যার চেষ্টা করেছে, ১৫ আগস্ট মিথ্যা জন্মদিন পালন করেন- তাদের সাথে কীভাবে সমঝোতা হয়? এদের সাথে সমঝোতা হতে পারে না। বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চায়।
জাতির পিতাকে অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়েরে প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এক অর্বাচীন যুবক (তারেক রহমান) প্রবাসে বসে ইতিহাসের নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছে। আর তাকে চালাচ্ছে খালেদা জিয়া। আইনমন্ত্রীকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, বিশ্বের কোন দেশে আছে জাতির পিতা, জাতীয় সঙ্গীত ও সংবিধানকে অবমাননা করলেও ব্যবস্থা নেয়া হয় না? এদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ব্যবস্থা নিতে হবে। এভাবে চলতে পারে না। আমরা রামকৃঞ্চ মিশন চালাতে ক্ষমতায় আসিনি। মনে রাখতে হবে এই অপশক্তিরা শক্তের ভক্ত, নরমের যম। সংবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নতুন আইন প্রণয়নের জন্য তিনি আইনমন্ত্রীর প্রতি দাবি জানান।

রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান অশিক্ষিত। অশিক্ষিত মা ছেলের বিকৃত ইতিহাস শুনে গোটা জাতি হতবাক। আইএসআইএ’র টাকা খেয়ে এজেন্ট হিসেবে তারা জাতির সঙ্গে বেইমানি করে যাচ্ছে। জাতির উচিত তারেক রহমানকে তাজ্য করা। আর সরকারের উচিত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া। হুইপ আতিউর রহমান আতিক রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অবিলম্বে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে বলেন, নির্বাচন ঠেকাতে না পেরে বিএনপি এখন বেসামাল হয়ে পড়েছে, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আবোল-তাবোল বকছেন। সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমীন এমিলি বলেন, খালেদা জিয়া লাদেনের চেয়েও খারাপ। তিনি এ দেশকে জঙ্গিবাদের উর্বর ভূমি করেছিলেন। চুরির দায়ে লন্ডনে পালিয়ে থাকা তারেক রহমান আইএসআইর টাকা নিয়ে দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড করছে।