তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নীতি নির্ধারণী কাজ ছিলো সংবিধান পরিপন্থি : হাইকোর্ট

স্টাফ রিপোর্টার: ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নীতি নির্ধারণী কাজ ছিলো সংবিধান পরিপন্থি। সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দৈনন্দিন কাজ ছাড়া ওই সরকারের নীতি নির্ধারণী কাজের কোনো এখতিয়ার ছিলো না। এটিসহ আরো কতক যুক্তিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের ওপর শতকরা ১৫ ভাগ কর আরোপকে অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। একই সাথে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে (২০০৭ সাল) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যে কর আদায় করা হয়েছে তা ফেরত দিতে সরকার ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ গতকাল সোমবার এ সংক্রান্ত জারিকৃত দুটি প্রজ্ঞাপনকে অবৈধ ঘোষণা করে এই রায় দেন। রায়ে বলা হয়েছে, তত্কালীন সরকার ছিলো একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সংবিধানের ৫৮(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিগণের সাহায্য ও সহায়তায় উক্তরূপ সরকার দৈনন্দিন কার্যাবলী সম্পাদন করবেন; এবং এইরূপ কার্যাবলী সম্পাদনের প্রয়োজন ব্যতীত কোনো নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। আর ওই সরকারের কাজ ছিলো একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা। কিন্তু তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের ওপর শতকরা ১৫ ভাগ ভ্যাট আরোপের মতো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেন যা সংবিধান পরিপন্থি ও বেআইনি।

রায়ে আরো বলা হয়, শিক্ষা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর কর আরোপের ফলে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। এই বৈষম্যমূলক পদক্ষেপের শিকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ফলে এই কর আরোপের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলো। এই রায়ের ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের উপর আরোপিত সেই কর আর দিতে হবে না বলে জানান আইনজীবীরা।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের ওপর কর আরোপ করে ২০০৭ সালের ২৮ জুন এনবিআর এক প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়, যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তাদের উদ্ভূত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পুনঃনির্ধারণ করা হলো। মেডিকেল, ডেন্টাল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও তথ্য শিক্ষাদানে নিয়োজিত প্রাইভেট কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আয় করমুক্ত হবে। কিন্তু ওই সকল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রতিবছর যথারীতি নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণীসহ আয়কর বিবরণী দাখিল করতে হবে। এই প্রজ্ঞাপনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তখন হাইকোর্টে রিট দায়ের করে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি। ওই বছরের ২ ডিসেম্বর রিটের ওপর রুল জারি করে হাইকোর্ট। এই রুল বিচারাধীন থাকাবস্থায় ২০১০ সালের ১ জুলাই এনবিআর আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে আগের প্রজ্ঞাপন রহিত করে বলা হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা কেবলমাত্র তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজ-এর উদ্ভূত আয়ের ওপর প্রদেয় আয়করের হার হ্রাস করে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো।

পরে এই প্রজ্ঞাপনেরও বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিভিন্ন সময়ে ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয় পৃথক ৪৬টি রিট দায়ের করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস টেকনোলজি, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (চট্টগ্রাম), ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি ও সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি।

এসব রিটের ওপর পৃথক পৃথক রুল জারি করেন আদালত। সম্প্রতি হাইকোর্টে ওই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে ২৫টি রিটের পক্ষে ব্যারিস্টার মুহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন ও অ্যাডভোকেট শাহ মোহাম্মদ আশিকুল মুরসেদসহ প্রমুখ আইনজীবী শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীর শুভ্র। শুনানি শেষে হাইকোর্ট উপরোক্ত রায় দেয়। রায়ে এ ধরনের প্রজ্ঞাপন জারিকে আয়কর অধ্যাদেশের ৪৪ ধারার পরিপন্থি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যারিস্টার শাখাওয়াত হোসেন বলেন, হাইকোর্ট দুটি প্রজ্ঞাপনকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি ওই প্রজ্ঞাপনের ক্ষমতাবলে যে অর্থ আদায় করা হয়েছে, তা ফেরত দিতে বলেছে। তিনি বলেন, এই রায়ের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আর আয়কর দিতে হবে না। সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীর বলেন, হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে শিগগিরই আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করা হবে।