ঢাকায় গণতন্ত্রের অভিযাত্রা : দেশজুড়ে উদ্বেগ নানা শঙ্কা

স্টাফ রিপোর্টার: আজ যেকোনো মূল্যে ঢাকায় নয়াপল্টনে সমাবেশ করার ঘোষণা ১৮ দলের। খালেদা জিয়ারও উপস্থিত থাকার কথা। ভোর থেকেই রাস্তায় নামার প্রস্তুতি। যেখানে বাধা সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তোলাসহ কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি। সব ধরনের বাধা ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে কর্মসূচি সফল করতে জোট নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে নাশকতার আশঙ্কা ব্যক্ত করে বিরোধী জোটের এ কর্মসূচি শক্ত হাতে প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগ। সব মিলিয়ে আজকের এ কর্মসূচিকে ঘিরে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা, শঙ্কা আর উদ্বেগ।

আইন ভেঙে অনুমতিবিহীন গণতন্ত্রের অভিযাত্রা কর্মসূচিতে ঢাকার নয়া পল্টনে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলেই তা ছত্রভঙ্গ করতে মারমুখি থাকবে পুলিশ। এজন্য প্রয়োজনে টিয়ারশেল এবং রাবার বুলেট ছুড়তেও দ্বিধা করবে না। এছাড়া সন্দেহভাজনদের গণহারে গ্রেফতারেও নেয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। শনিবার ভোর থেকেই ঢাকার চারটি প্রবেশমুখে থাকছে দু ধাপের স্পেশাল চেকপোস্ট। রণপ্রস্তুতি নিয়ে রাজপথে সশস্ত্র টহল দেবে পুলিশ-র‌্যাবসহ যৌথ বাহিনী। রাজধানীর বাইরে দেশের প্রতিটি জেলার নিরাপত্তায়ও নেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা। চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুর ঝিনাইদ, কুষ্টিয়াসহ দেশের প্রায় সকল এলাকা থেকে ঢাকার বাস, ট্রেন ও লঞ্চ যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের নেতাকর্মীরা যেন রাজধানীতে প্রবেশ কিংবা নয়াপল্টনে দাঁড়াতেই না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রস্তুত আওয়ামী লীগও। দু পক্ষের কঠোর এ অবস্থানে দেশজুড়ে জনমনে বিরাজ করছে চরম উদ্বেগ। ভয়াবহ সংঘাত-সহিংসতা আর বহু প্রাণহানির আশঙ্কায় উৎকণ্ঠায় দেশ। নয়াপল্টনে গণজমায়েত বা সমাবেশের জন্য অনুমতি পায়নি বিএনপি। কিন্তু অনুমতি না দিলেও যে কোনো মূল্যে আজকের গণতন্ত্রের অভিযাত্রা কর্মসূচি সফল করার ঘোষণা দিয়েছে ১৮ দলীয় জোট। নেতাকর্মীসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষকে জাতীয় পতাকা হাতে মার্চ করে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জমায়েত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। ঢাকামুখি নেতাকর্মীদের সমবেত হতে বাধা দেয়া হলে, যেখানে তা দেয়া হবে, সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও কেন্দ্রীয়ভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর সংঘাত হলে আজই নতুন ও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা দিতে পারে দলটি।

বিপরীতে বিরোধীদলকে রাজধানীর কোথাও জমায়েত হতে দেয়া হবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের মোকাবেলা করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে আজ রাজপথে থাকবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। রাজধানীর আট স্থানে অবস্থান নিয়ে ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের ঠেকাতে তৈরি তারা।
কর্মসূচিকে ঘিরে সরকার ও বিরোধীদলের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে রাজধানীসহ সারাদেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। উভয় দল অনড় অবস্থানে থাকায় রাজধানীতে ভয়াবহ সহিংসতা ও প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন অনেকেই। ঢাকায় সংঘর্ষ শুরু হলে তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ। অভিযাত্রা ঠেকাতে এরই মধ্যে সরকারের অলিখিত সড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রাজধানী। আতঙ্কে বন্ধ হয়ে গেছে সারাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা। আর এতে ভয়াবহ ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ।

জানা গেছে, গণতন্ত্রের অভিযাত্রা সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি। সকাল থেকেই শুরু হবে এ গণজমায়েত। সকাল ১০টার মধ্যে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সিনিয়র নেতাদের উপস্থিত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন খালেদা জিয়া। সারাদেশ থেকে আসা কর্মীরা নয়াপল্টনে আসার আগে নেতাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে গণজমায়েত মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার কথা রয়েছে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার। শুক্রবার এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছেন, কোনো কারণে তিনি উপস্থিত হতে না পারলেও দেশবাসী ও নেতাকর্মীরা যেন কর্মসূচি চালিয়ে যান।

সব বাধা উপেক্ষা করে আজকের গণজমায়েতে অংশ নিতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আওয়ামী শাসকের হাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার পুনরুদ্ধারের স্বার্থে সব শ্রেণিপেশার মানুষজনকে দেশনেত্রী ঢাকায় আসার ডাক দিয়েছেন। সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আজকের কর্মসূচিতে সব শ্রেণিপেশার মানুষকে অংশ নিতে আমিও উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।

এদিকে এদিন খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে বের হতে দেয়া হবে কি-না এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে সংশয়। বিরোধীদলীয় নেতা রাজপথে না নামলে দলের সিনিয়র ও মহানগরীর নেতারা আজকের গণজমায়েতে অংশ নেবেন কি-না তা নিয়েও তৃণমূল নেতাকর্মীদের সংশয় রয়েছে। বিএনপির একটি সূত্র জানায়, কোনোভাবেই আজ কর্মসূচি করতে না পারলে কাল সোমবার বা পরশু মঙ্গলবার আবার সমাবেশ করতে ডিএমপির অনুমতি চাওয়া হতে পারে। তারপরও সমাবেশের অনুমতি না দিলে ১ জানুয়ারি থেকে টানা কর্মসূচি শুরু হবে। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ নেতাই অসহযোগ আন্দোলন এবং নির্বাচনের দু দিন আগে থেকে অসহযোগের পাশাপাশি গণকারফিউ কর্মসূচি দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে আজকের ব্যাপক সহিংসতা বা সংঘর্ষ হলে তাৎক্ষণিকভাবে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে।

দশম জাতীয় সংসদের আসন্ন একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করতে ঢাকার পথে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করেন ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২৪ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি।

তৃণমূল নেতাকর্মীরা ঢাকায়: কর্মসূচি সফল করতে কেন্দ্রীয় ও মহানগর বিএনপির কোনো তৎপরতা না থাকলেও ইতোমধ্যে সারাদেশ থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীরা ঢাকায় এসেছেন। শনিবারও অনেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসা, থাকা-খাওয়া এবং আজ কোথায় অবস্থান করবেন এ পুরো বিয়ষটি দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করছেন স্ব স্ব জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। কীভাবে গ্রেফতার এড়িয়ে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায় সেদিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যার যার জেলার নেতারা রাজধানীর কোনো একটি স্থানে জড়ো হয়ে সেখান থেকে জাতীয় পতাকা হাতে নয়াপল্টনের উদ্দেশে মার্চ করবে। যেখানে বাধা দেয়া হবে, সেখানে তারা বসে যাবেন। প্রয়োজনে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশও দেয়া হয়েছে তাদের। এদিকে বড় জমায়েতের মূল টার্গেট ঢাকার আশপাশের অন্তত ৯টি জেলা। ওই জেলাগুলো থেকে কয়েক লাখ লোক আজকের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

এলডিপির আহ্বান: ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি সফল করতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এলডিপিও। দলটির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব শাহাদত হোসেন সেলিম বলেন, সরকার ১৮ দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বরাবরই বাধা দিয়ে আসছে। আজকের কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ যেন ঢাকা আসতে না পারে সেজন্য সরকার নিজেই অবরোধ পরিস্থিতির অবতারণা করেছে। বাস-ট্রেন-লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে। কিন্তু সরকার যতই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করুক না কেন, ১৮ দলীয় জোট নেত্রীর ডাকা কর্মসূচি যে কোনো মূল্যে সফল করা হবে। কর্মসূচি সফল করতে শনিবার রাজধানীতে এলডিপির যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়।

বিকল্পধারার আহ্বান: বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিরোধীদলের ঢাকার পথে অভিযাত্রা কর্মসূচিতে বাধা না দিয়ে তা সম্পন্ন করতে সহযোগিতার জন্য সরকারকে এবং কর্মসূচি যেন কোনো রকমেই সহিংস না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে বিরোধীদলীয় নেতাকে আহ্বান জানিয়েছে। শনিবার সংবাদ বিবৃতিতে এ আহ্বান জানিয়ে বি. চৌধুরী বলেন, বিকল্পধারা বাংলাদেশ তৎক্ষণ পর্যন্ত বিএনপির গণতান্ত্রিক ঢাকা অভিযাত্রাকে নীতিগতভাবে সমর্থন দেবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তা অহিংস থাকবে। এ জন্য আমরা বারবার বলেছি, সরকার এ অভিযাত্রাকে বাধা না দিয়ে যেন সহযোগিতা করে।

জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোর প্রস্তুতি: গণতন্ত্রের অভিযাত্রা সফল করতে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ইসলামী দলগুলোও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। ইতোমধ্যে সারাদেশ থেকে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা ঢাকায় অবস্থান নিয়েছেন। সরকার কর্মসূচিতে বাধা দিলে তা মোকাবেলার প্রস্তুতিও নিয়েছে জামায়াত-শিবির। এদিকে কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উপায়ে সর্বাত্মকভাবে সফল করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিতে দেশব্যাপি জনগণের জাগরণে বেসামাল হয়ে সরকার যৌথবাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে জনগণের মাঝে ভীতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা এ কর্মসূচি বানচাল করার জন্য উসকানিমূলক ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করছেন।

জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সভাপতি শায়খ আবদুল মোমিন, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতীফ নেজামী, মধুপুরের পীর মাওলানা আবদুল হামীদ, খেলাফত মজলিসের চেয়ারম্যান মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক, খেলাফত আন্দোলনের আমীর শরীয়ত মাওলানা আহমদুল্লাহ আশরাফ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা হাবীবুর রহমান, নেজামে ইসলাম পার্টির মাওলানা আবদুর রকীব অ্যাডভোকেট, খেলাফতে ইসলামীর চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী, ওলামা কমিটির চেয়ারম্যান মাওলানা শামসুল আলম, ফরায়েজি আন্দোলনের মাওলানা আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ হাসানসহ আরও বেশ কয়েকজন ওলামা মাশায়েখ পৃথক বিবৃতিতে আজকের গণজমায়েতে অংশ নিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।