ডক্টরস ক্লিনিকে স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু রহস্যঘনীভূত

আটক ৪ জনকে জেলহাজতে প্রেরণ : দোষীদের বিচার দাবিতে মিছিল

 

শাহনেওয়াজ খান সুমন: ঝিনাইদহ শহরের উপজেলা পরিষদ সড়কে বেসরকারি হাসপাতাল ডক্টরস ক্লিনিকে স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যুর রহস্য ঘনীভূত হয়েছে। ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে শনিবার রাতেই তাদের ময়নাতদন্ত করা করা হয়। ঝিনাইদহ সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে ডা. ইমদাদুল হককে প্রধান করে এবং ডা. মোকাররম হোসেন ও ডা. জাহিদুল ইসলামকে সদস্য করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

রাতে কেন ময়নাতদন্ত, পর্যাপ্ত আলো কী ছিলো? এসব প্রশ্নের জবাব যেমন স্পষ্ট নয়, তেমনই সুরতহাল রিপোর্ট প্রণয়নের সময় মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ময়নতদন্ত রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে পুলিশকে।

সূত্র বলেছে, ময়নাতদন্তেও মৃত্যুর কারণ অনেকটা অস্পষ্ট হওয়ার কারণেই নিহত স্বামী স্ত্রীর মৃতদেহের ভিসেরা আর রক্ত পাঠানো হয়েছে ঢাকায়। অপরদিকে ক্লিনিকের চার কর্মচারীকে আটকের পর জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।

গতকাল রোববার সকালে মাগুরায় নিহতের গ্রামের বাড়িতে দুজনের লাশ নেয়া হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন আত্মীয়স্বজন। এ ঘটনাটিকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ওই দম্পতির পরিবার ও স্থানীয়রা। দোষীদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে এলাকাবাসী। চিকিৎসক ও তার সহযোগীদের উপযুক্ত শাস্তি না দেয়া হলে এলাকাবাসী মাগুরা-ঝিনাইদহ সড়ক বন্ধ করে দেয়াসহ কঠোর ঘোষণা দিয়েছে স্থানীয়রা।

পুলিশ ও নিহতের পারিবারিকসূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার নিসঃন্তান দম্পতি মাগুরা সদর উপজেলার বগুড়া গ্রামের ঝন্টু ফকিরের ছেলে জুয়েল হোসেন (৩০) ও স্ত্রী নাসরিন খাতুনের (২৬) সন্তান লাভের আশায় চিকিৎসার জন্য ঝিনাইদহ শহরের ডক্টরস ক্লিনিকে আসেন। ক্লিনিকের মালিক ডা. হামিদুন্নেছা পাখি তাদেরকে ৯টি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দেন। ওই দিন প্যাথলজি বন্ধ থাকায় তারা বাড়ি ফিরে যান। শনিবার সকালে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে আসেন। তবে সিমেন সংগ্রহের জন্য স্বামী-স্ত্রীকে একটি কক্ষে পাঠানো হয়। প্রায় দু ঘণ্টা পর ওই কক্ষের তালা ভেঙে ভেতর থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

নিহত দম্পত্তির বাড়িতে গিয়ে কথা হয় পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসীর সাথে। বাড়ির বাইরের উঠোনে স্বামী, ভেতরের ওঠানে স্ত্রীর লাশ। পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি শোকের মাতম পুরো গ্রামের মানুষের মাঝে। সন্তানের আশায় চিকিৎসা নিতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে আসবে প্রিয়জন, এমনটা ভাবেননি কেউ। ছয় বছরের দাম্পত্য জীবনে সবই ছিলো, ছিলো না কেবল সন্তান। গতকাল সকালে মৃত দম্পতির লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছুলে এলাকাবাসীর শোক পরিণত হয় বিক্ষোভে।

নিহতের এক স্বজন বলেন, জোড়া খুন হইছে। এ ধরনের ঘটনা কোথাও ঘটে না। আমরা এর বিচার চাই, আসামিদের ফাঁসি চাই। এ ঘটনাকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে ক্লিনিকের মালিক ও ডাক্তার হামিদুন্নেছা পাখির বিচার দাবি করেছেন নিহতের স্বজনরা।

পরিবারের লোকজন জানান, মোবাইলফোনে কথা হয় জুয়েল ও নাসরিনের সাথে। তারা জানিয়েছিলেন, ডক্টরস ক্লিনিকের লোকজন তাদের দুজনকে দুটি ইনজেকশন দিয়ে একটি ঘরের মধ্যে রাখেন। প্রায় ২ ঘণ্টা পর ওই ঘর থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনাটিকে একটি ঠাণ্ডা মাথার খুন দাবি করে ক্লিনিকের মালিক প্রভাবশালী চিকিৎসক পাখিকে গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে মাগুরার বগুড়া এবং ফুলবাড়ি গ্রামের দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ করেছে। এ খুনের সঠিক বিচার না হলে মাগুরা-ঝিনাইদহ সড়ক বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। মাগুরার ১নং হাজিপুর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হারুন আর রশিদ বলেন, এ ঘটনায় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হত্যামামলা করা হবে।

এদিকে গতকাল গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. হামিদুন্নেছা পাখির সাথে যোগযোগের চেষ্টা করলে তিনি অসুস্থ বলে জানায় তার পরিবার। তবে ক্লিনিক মালিক ডা.পাখির স্বামী কাজী গিয়াস আহমেদ দাবি করেছেন ঘটনাটি ক্লিনিকের নয়, তার মালিকানাধীন নবগঙ্গা প্যাথলজিতে ঘটেছে। তিনি বলেন, শনিবার তারা এ টেস্টগুলো করতে আসছিলো তখন তারা সুস্থ ছিলো। তারা ব্লাড ও ইউরিন টেস্টের জন্যে দিয়েছিলো এবং বাকি টেস্টগুলো করার জন্য তাদেরকে আমি পরে আসতে বলি।

তবে পুলিশ জানিয়েছে, মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে সব ধরনের চেষ্টা চলছে। ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহাবুদ্দীন আজাদ পিপিএম বলেন, বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখছি যে কি কারণে এ ঘটনাগুলো ঘটতে পারে। সব বিষয় সামনে রেখে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এ ঘটনায় শনিবার রাতে পুলিশ ক্লিনিকের নার্স রোখসানা পারভীন, ম্যানেজার কাজী রাশেদুল নেছা শিউলী, টেকনোলজিস্ট স্বপন আলি ও অ্যাসিসট্যান্ট ল্যাব টেকনিশিয়ান কলিমুদ্দিনকে আটক করেছে। পরে ১৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করলে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি বলে জানান তিনি।

ঝিনাইদহের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. রাশেদা সুলতানা বলেন, মৃতদেহ দুটিতে হত্যা বা আত্মহত্যার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। কী কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে তাও জানা যায়নি ময়নাতদন্তে। রক্ত ও ভিসেরা সংগ্রহ করা হয়েছে। পরীক্ষার জন্য তা ঢাকায় মহাখালীর পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে রিপোর্ট এলে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।