টেন্ডারবাজির দিন শেষ হচ্ছে : অফিসে অফিসে ই-টেন্ডারিং

স্টাফ রিপোর্টার: ই-টেন্ডারিঙে বদলে যাচ্ছে দুর্নীতি ও টেন্ডারবাজির দৃশ্যপট। টেন্ডার ছিনতাই, টেন্ডার জমা দিতে দুপক্ষের মারামারি, কর্তৃপক্ষের নানা কারসাজি এখন প্রায় অতীত। সকল সেক্টরে ই-টেন্ডার চালু হলে টেন্ডারবাজি শব্দটিই একদিন মানুষের কাছে অচেনা হয়ে যাবে।

বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এ পর্যন্ত ২০টির বেশি সরকারি অফিসে ই-টেন্ডারিং চালু করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সরকারি অফিস। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে এ পদ্ধতিতে। এতে টেন্ডারবাজি হওয়ার কোনো প্রকার আশঙ্কা নেই। ঠিকাদাররা ঘরে বসেই টেন্ডার জমা দিতে পারছেন। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাঈদ আহমেদ পলক বলেন, আমরা পর্যায়ক্রমে সরকারের প্রতিটি দফতরে ই-টেন্ডারিংয়ে নিয়ে যাব। যাতে এ নিয়ে কোন প্রকার মস্তানি না থাকে। রাজনীতির মূল স্খলন হচ্ছে টেন্ডারবাজি। সব সরকারের আমলেই টেন্ডারবাজি নিয়ে খুনাখুনির মতো ঘটনা ঘটে। ই-টেন্ডার পদ্ধতি চালু হলে আর কারও মস্তানি-টেন্ডার ছিনিয়ে নেয়ার কোন বিষয় থাকবে না। যেসব দফতরে ই-টেন্ডারিং ব্যবস্থা চালু হয়েছে, ওইসব দফতরে কোন ধরনের টেন্ডারবাজি নেই। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে দরপত্রের প্রস্তাব, মূল্যায়ন চুক্তি ব্যবস্থাপনা ও ই-পেমেন্টসহ সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো কাজই স্বল্প সময়ে, সহজে ও সমন্বিতভাবে করা সম্ভব হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ই-টেন্ডারিংয়ে বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি ভাল করেছে। এ প্রক্রিয়ার পাইলট কার্যক্রম সফল হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ই-টেন্ডারিং মূল্যায়ন সংক্রান্ত ১১ সদস্যের একটি মিশন এ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেছে।

ই-টেন্ডারিং প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থ সহযোগিতা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের যোগাযোগ কর্মকর্তা মেহেরিন এ মাহবুব জনকণ্ঠকে জানান, আমরা আশাবাদী এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে। সে সঙ্গে দুর্নীতি ও টেন্ডারবাজির দিনও শেষ হবে। কেননা ইতোমধ্যেই ই-টেন্ডারিং বাংলাদেশে প্রশংসনীয়ভাবে এগিয়েছে। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হচ্ছে ২০১২ সালের জুন মাসে যেখানে রেজিস্ট্রিকৃত ঠিকাদারের সংখ্যা ছিলো ২৯৪ জন সেখানে এক বছরের কিছু সময়ের মধ্যেই এ সংখ্যা ৬ হাজার পার হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) মহাপরিচালক অমূল্য কুমার দেবনাথ জনকণ্ঠকে বলেন, অনলাইনে টেন্ডার ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে দরপত্র ছিনতাই ও দরপত্রদাতাদের ভয়ভীতি দেখানো বা কোনরকম দুর্নীতি করার সুযোগ থাকছে না। এ ছাড়া অনলাইনে প্রমিসের (প্রকিউরমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) মাধ্যমে সংস্থাসমূহের প্রক্রিয়াকরণকৃত দরপত্রে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা সে বিষয়েও পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ই-টেন্ডারিং বাস্তবায়নের জন্য ৩৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ভারতীয় ফার্ম জিএসএস আমেরিকা ইনফোটেক লিমিটেডকে প্রধান পরামর্শক, এবিসি প্রকিউর এবং সরকার মনোনীত প্রতিষ্ঠান দোহাটেক নিউ মিডিয়াকে সহপরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়। এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য উপাদান ডিজিটাল সিগনেচার তৈরির জন্য ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে কন্ট্রোলার অব সার্টিফাইং অথরিটির নিয়ন্ত্রক হিসেবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) তখনকার মহাপরিচালক মাহফুজার রহমানকে নিয়োগ দেয়া হয়। এ ছাড়া সরকারী ক্রয় বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টিতে সিপিটিইউ ৩ বছর মেয়াদি একটি যোগাযোগ কৌশলপত্র বাস্তবায়ন করেছে। কৌশলপত্র অনুযায়ী বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষা, কর্মশালা, বিনোদন, দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম, টেলিভিশন, রেডিও, পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, প্রতিবেদন ও নিবন্ধ প্রকাশসহ বিভিন্নভাবে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সচেতন করে তোলার কাজ করা হয়।

প্রথমপর্যায়ে সরকারি চারটি সংস্থা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে পরীক্ষামূলকভাবে ই-টেন্ডারিং চালুর কারণ হিসেবে জানা গেছে, প্রতিবছর সরকারীভাবে যে ক্রয় কাজ করা হয় তার অধিকাংশই এ চারটি সংস্থা সম্পন্ন করে থাকে। তাই এ ৪টি বৃহৎ সংস্থাকেই পাইলট প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছিলো।

সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ) সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় ই-জিপি পোর্টালের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৭টি মন্ত্রণালয়ের ২১টি সংস্থার ১১৪টি অফিস ই-টেন্ডারিংয়ে যুক্ত হয়েছে। ৬ হাজার ৭৪৬ ঠিকাদার এ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হতে রেজিস্ট্রেশন করেছেন। ১৮টি ব্যাংকের ৩৭৭টি শাখা সারাদেশে অনলাইনে দরপত্র সংক্রান্ত ফি ও সিকিউরিটি গ্রহণের কাজ করছে। পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও সিপিটিইউ এর লক্ষ্য ছিল ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৩৫টি টেন্ডার আহ্বান করার। সেখানে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই গত ২৫ নবেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৯২০টি টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮২০টির চুক্তি অনলাইনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণ সমাপ্ত করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত যেসব সরকারি সংস্থা যুক্ত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে, সেতু কর্তৃপক্ষ, বিবিএস, বিপিসি, বিপিডিপি, বিডব্লিউডিবি, ডিপিএইচই, ডেসকো, ডিপিডিসি, আইএমইডি, ডিসিসি দক্ষিণ, ঢাকা ওয়াসা, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, জিটিসিএল, এলজিইডি, পিজিসিবি, পিডব্লিউডি, রাজউক, আরএইচডি, আরইবি এবং মাউশি। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারের চারটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় এটি চালু করা হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। এ সংস্থাগুলোর ১৭টি অফিসে চালু হয়েছিল প্রথম ই-টেন্ডারিং।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উন্নয়ন কার্যক্রম আরও গতিশীল করা ও সরকারী অর্থ ব্যয় অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্যই ই-টেন্ডারিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ২০১১ সালের ২ জুন এ প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) তত্ত্বাবধানে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রিফর্ম প্রজেক্ট-২ (পিপিআরপি-২) এর আওতায় একটি আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ই-জিপি সিস্টেম প্রস্তুত ও পরীক্ষার কাজ করা হয়েছিল। ই-জিপি একটি জাতীয় পোর্টাল যা ব্যবহার করে দরদাতা এবং ক্রয়কারী উভয়েই ক্ষেত্রমতো ইন্টারনেটের মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান, সংগ্রহ, দাখিল, মূল্যায়ন এবং সর্বশেষ চুক্তি স্বাক্ষরে সক্ষম হচ্ছেন। এতে সরকারী ক্রয় কার্যক্রমে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হচ্ছে এবং দ্রুততার সঙ্গে ক্রয় কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার ফলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে।

সূত্র জানায়, ই-জিপি দুই পর্যায়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। তা হচ্ছে ই-টেন্ডারিং এবং ই-কনট্রাক্ট ব্যবস্থাপনা। এ পোর্টাল ব্যবহার করতে হলে দরদাতা, ক্রয়কারী ও ব্যাংকসমূহকে ই-জিপি পদ্ধতিতে নিবন্ধন করতে হয়। প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ৪টি সংস্থায় ২০টি অফিসে চালু হলেও পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে সবগুলো মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বিস্তৃত করা হচ্ছে।

পিপিআরপি-২ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্ব ব্যাংকের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) আওতায় সেন্টাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ) কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে পুরনো সরকারী ম্যানুয়েলের পরিবর্তে সরকার প্রথমে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট এ্যাক্ট এবং পরবর্তীতে সরকারী ক্রয় বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে গৃহীত সরকারী ক্রয় সংস্কার প্রকল্প (পিপিআরপি)-২ এর আওতায় ইলেকট্রনিক গবর্মেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) পদ্ধতি উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই ই-জিপি পদ্ধতির প্রথম ধাপ হচ্ছে ই-টেন্ডারিং।