তিন মহাশক্তির বিরুদ্ধে টানা তিনটি সিরিজ জয় বাংলাদেশের
স্টাফ রিপোর্টার: পাকিস্তান ও ভারতের পর দক্ষিণ আফ্রিকা। তিন মহাশক্তির বিরুদ্ধে টানা তিনটি সিরিজ জয়। পূর্ণ হলো একটা স্বপ্নের বৃত্ত। রংধনুর দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা কী ভেবেছিলো এমন দুঃস্বপ্ন অপেক্ষা করছে তাদের জন্য? মোজার্টের সুরে জীবনের যে সুখ নিহিত, লাল-সবুজের ক্রিকেটে এখন সেই সুখস্নাত অনুভূতি। সাকিব আল হাসান আগের দিন বলেছিলেন, সিরিজ জিতলে বিশাল একটা অর্জন হবে। আগে যা কখনও হয়নি। যা আপনি পাননি কখনও, সেটা যদি পাওয়া যায় তার ব্যাপ্তিটা খুব বড় হয়।
যা কোনো দিন পাওয়া যায়নি, তা পাওয়া হলো কাল। ঐতিহাসিক সিরিজ জয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। প্রথম ওডিআই হেরে পরপর দুটিতে জয়। এবার ৯ উইকেটে। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের ইতিহাস গড়ার ক্ষণকাল রাতে নিশ্চিতভাবে প্রত্যক্ষ করেছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। আফ্রিকার সিংহদের বিড়াল বানিয়ে তামিম-সৌম্যরা প্রথমবারের মতো ২-১ এ ওয়ানডে সিরিজে হারালেন হাশিম আমলাদের। ক্রিকেটবিশ্ব দেখলো সাকিব আল হাসান ও মাশরাফি মুর্তজা ২০০ উইকেট ক্লাবের সদস্য হলেন সগৌরবে। এরপর সৌম্য-তামিম মিলে মরকেল-রাবাদার কংক্রিটের প্রাচীর ভেঙে দিলেন অনায়াসে। বাংলাদেশ লাল-সবুজ স্বপ্নের সাথে আবেগ মিশিয়ে, তাতে সামর্থ্যরে থোকা থোকা ফুল ফুটিয়ে, এমন সৌরভ ছড়াল, যে সৌরভে তাদের শৌর্য-স্বকীয়তা মিলেমিশে একাকার। বুধবার প্রাক-ঈদ উৎসবের রং আরও উজ্জ্বল হলো বাংলাদেশের আরেকটি ক্রিকেটীয় সৌকর্যে। দক্ষিণ আফ্রিকার ২৩তম ওভারে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলো গোটা জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম। প্রায় তিন ঘণ্টা পর আবার যখন খেলা শুরু হয়, ব্যাঘ্রগর্জনে তখন প্রকম্পিত প্রোটিয়ারা। ৪০ ওভারে করতে হবে ১৬৯। সৌম্য-তামিম শুরুটা করেন আবদুল আলীমের পল্লীগীতির মতো- ‘হলদিয়া পাখি সোনালি বরণ, পাখিটি ছাড়িলো কে’। কাল সাতক্ষীরার তেঁতুলিয়ায় সৌম্যর গ্রামে প্রথম বিদ্যুৎ গেলো। গোটা গ্রাম আলোকিত। আর সৌম্য চট্টগ্রামে আলো জ্বালালেন ব্যাটকে সুইচ বানিয়ে।
আগের ম্যাচে অপরাজিত ৮৮। কাল ১০ রানের জন্য মিস করলেন সেঞ্চুরি। ৭১ বলে ৯০। এতটাই আগ্রাসী তার ব্যাটিং যে, তামিম ইকবালের ফিফটিও কেমন যেন পানসে দেখালো। অপরাজিত ৬১। উদ্বোধনী জুটিতে এ দু’জন ১৫৪ রান তুলে বাংলাদেশকে পৌঁছে দিলেন এভারেস্টে। প্রোটিয়াদের দুর্গ দখল করতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি টাইগারদের। ৮৩ বল বাকি থাকতে বাংলাদেশ মাত্র এক উইকেট হারিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। লিটন কুমার দাস চার মেরে বাংলাদেশকে এনে দেন কাঙ্ক্ষিত জয়। সাকিব, মুশফিকুর সাজঘরেই বসে রইলেন। রাবাদা, মরকেলরা রইলেন উইকেটশূন্য। মায়াবী বিভ্রম নয়, বাঘদের কুঠারাঘাতে ছিন্নভিন্ন প্রোটিয়ারা।
ঈদ উৎসবে নতুন জামা-কাপড়ের আনন্দ এর কাছে ম্লান। কাল সারা রাত বৃষ্টি হয়নি। আকাশের যা কান্না-টান্না সব সেরে ফেলা হয় সকালে-দুপুরে-অপরাহ্নে। রাত উৎসবের রেণু ছড়ায়। কাল ছিল চাঁদ রাত। ক্রিকেটআকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠল। সেই চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত ক্রিকেটবিশ্ব। এর আগে টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুতেই পথ হারিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ৫০ রানেই নেই চার উইকেট! মুস্তাফিজুর রহমান ও সাকিব আল হাসানের দ্বিমুখি আক্রমণে প্রোটিয়ারা তখন রীতিমতো কাঁপছে। ২৩ ওভার শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ যখন চার উইকেটে ৭৮, তখনই হাজির হয় বেরসিক বৃষ্টি। প্রায় তিন ঘণ্টা খেলা বন্ধ ছিল বৃষ্টির কারণে। বৃষ্টি থামার পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আবার যখন খেলা শুরু হয় ম্যাচের দৈর্ঘ্য নেমে আসে ৪০ ওভারে। শেষ পর্যন্ত ধুঁকতে ধুঁকতে ৪০ ওভারে নয় উইকেটে ১৬৮ রানে থামে দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে বৃষ্টি-আইনে ৪০ ওভারে বাংলাদেশের সামনে জয়ের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৭০।
বৃষ্টি-বিরতির পর প্রথম আঘাত হানেন মাশরাফি মুর্তজা। পঞ্চম উইকেটে ৬৩ রানের জুটি গড়ে ইনিংস মেরামতের চেষ্টায় ছিলেন ডেভিড মিলার ও জেপি ডুমিনি। ইনিংসের ৩০ ওভারে বিপজ্জনক হয়ে ওঠা মিলারকে ফিরিয়ে সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন মাশরাফি। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ অধিনায়কের ২০০তম শিকার মিলার। একই ম্যাচে কাল বাংলাদেশের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বোলার হিসেবে ওয়ানডেতে ২০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করলেন সাকিব ও মাশরাফি। বৃষ্টি-বিরতির আগেই প্রোটিয়া অধিনায়ক হাশিম আমলাকে ফিরিয়ে সাকিব পেয়ে যান তার ২০০তম উইকেট। পরে দলীয় ১১৩ রানে সাব্বির রহমানের হাতে দারুণ এক ক্যাচ বানিয়ে মিলারকে ফিরিয়ে সেই অভিজাত ক্লাবে ঢুকে যান মাশরাফি। ৫১ বলে ৪৪ করে মিলারের বিদায়ের পর একাই লড়েছেন ডুমিনি। ইনিংসের শেষ বলে রুবেল হোসেনের দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হওয়ার আগে সর্বোচ্চ ৫১ রান করেন তিনি। ডুমিনি ও মিলার ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসে বলার মতো রান নেই আর কারও। মিলারের বিদায়ের পর ফারহান বেহারডিয়েনকে (১২) নিজের তৃতীয় শিকার বানিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আর ঘুরে দাঁড়াতে দেননি সাকিব। বৃষ্টিতেও বাংলাদেশের বোলারদের ছন্দপতন ঘটেনি। স্লগ ওভারে শুরুর ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার সুযোগই পায়নি প্রোটিয়ারা। শেষ পাঁচ ওভারে মাত্র ১৯ রানে চার উইকেট হারায় তারা। ৩৩ রানে তিন উইকেট নিয়ে সাকিবই কাল বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল বোলার। এছাড়া মুস্তাফিজ ও রুবেলের ঝুলিতে গেছে দুটি করে উইকেট। একটি করে উইকেট মাহমুদউল্লাহ ও মাশরাফির।
দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের তখন ২৩ ওভার শেষ হয়েছে। এমন সময় শুরু হয় বৃষ্টি। তখন বিকেল ৪টা ৩৫। মিনিটদশেক পর বৃষ্টি আরও বাড়ে। দক্ষিণ আফ্রিকা তখন ৭৮/৪। জেপি ডুমিনি ৮ এবং ডেভিড মিলার ২৩ রান নিয়ে ব্যাট করছিলেন। ৮ রান করতেই ডুমিনি খেলেন ২৫ বল। আর মিলার ২৭ বলে করেন ২৩। এর আগে সাকিব আল হাসান ফাফ ডু প্লেসি ও হাশিম আমলাকে ফিরিয়ে দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে ২০০ উইকেট পেলেন ওডিআইতে। এই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন তিনি দ্রুততম সময়ে। সাকিব এই মাইলফলক স্পর্শ করেন ১৫৬ ম্যাচে। জ্যাক ক্যালিসের লেগেছিল ২২৩ ম্যাচ। সাকিব ওয়ানডেতে ৪০০০ রান ও ২০০ উইকেটের ডাবল পূর্ণ করা ইতিহাসের সপ্তম ক্রিকেটার। ডু প্লেসি ১৭ বলে ছয় রান করে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিতে বাধ্য হন মুশফিকুর রহিমকে। আর দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক হাশিম আমলা রানখরা অব্যাহত রেখে ৩৫ বলে ১৫ করে মুশফিকুরেরই গ্লাভসবন্দি হন। এ নিয়ে টানা সাতটি ওডিআই ইনিংসে ফিফটি করতে ব্যর্থ হলেন আমলা। এর আগে এতদিন তিনি এমন খরায় ভোগেননি। এগারোতম ওভারে রুবেলের করা নো বল থেকে ফ্রিহিটের ক্যাচ তুলে দেন আমলা। পরের ওভারে সাকিবের বলে তুলে মারতে গিয়ে আবারও ক্যাচ দিয়েছিলেন প্রোটিয়া দলনায়ক। সাব্বিরের হাত ফসকে যায় সহজ ক্যাচ। দু বার রক্ষা পেলেও শেষ পর্যন্ত সাকিবের ২০০তম উইকেটে আমলা পরিণত হন।
টসে জিতে আমলা আবারও ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন। আবারও বুমেরাং হয় তার সিদ্ধান্ত। তৃতীয় ওভারেই ওপেনার কুইন্টন ডি কক (৭) বোল্ড হন মুস্তাফিজুরের বলে। দক্ষিণ আফ্রিকা তখন ১/৮ আর রিলে রুশো যখন সাজঘরে ফেরেন, সফরকারীরা তখন ৪/৫০, ১৬তম ওভারে। শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকা এই ম্যাচে ক্রিস মরিসকে বসিয়ে মরনে মরকেলকে খেলায়। বাংলাদেশ অপরিবর্তিত একাদশ মাঠে নামায়। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে গত তিন বছরে এটি তৃতীয় ওডিআই। এ সময়ে মিরপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছে ৩৫টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন: পাকিস্তান ও ভারতের পর ধারাবাহিকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজ জয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।