টর্নেডোর আঘাতে প্রাণ গেলো ৮ জনের

 

ফরিদপুরে জুট মিলের চাল ভেঙে চারজনসহ ছয় জনের মৃত্যু, বিভিন্ন স্থানে দুই সহস্রাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের বিভিন্ন স্থানে গতকাল রোববার বয়ে যাওয়া আকস্মিক টর্নেডোর আঘাতে আটজন নিহত হয়েছে। ফরিদপুর সদর উপজেলায় দুই মিনিট স্থায়ী ঝড়ে ছয়জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছে। এরমধ্যে জোবাইদা করীম জুট মিলের চাল ভেঙে পড়ে চার শ্রমিক নিহত হয়েছেন। অপর দুইজন গাছের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে দুই সহাস্রাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা খোলা আকাশের নিচে বাস করছেন। প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর

ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, গতকাল বেলা ১টার দিকে সদর উপজেলায় দেড় থেকে দুই মিনিট স্থায়ী টর্নেডোর আঘাতে চার পাটকল শ্রমিকসহ ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষ। এছাড়াও শতাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। সহস্রাধিক গাছপালা ভেঙে পড়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিদ্যুত ব্যবস্থা, বন্ধ হয়ে যায় মহাসড়কের যান চলাচল।

জানা যায়, বাখুণ্ডা এলাকায় জোবাইদা করিম জুট মিলের শেডের প্রায় ৫/৬ হাজার বর্গফুট স্টিলের চাল ভেঙে পড়ে। চালের নিচে চাপা পড়ে এক নারীসহ চার শ্রমিক মারা যায়। এরা হলেন- হযরত আলী (৪০), আকাশ (২২), মালতি (২৫) ও চান মিয়া (৩৫)। এসময় আহত হয় অন্তত ৫০ শ্রমিক। মিলের জেনারেল ম্যানেজার মতিউর রহমান জানান, আহত শ্রমিকদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এদিকে ঝড়ে গাছচাপা পড়ে সদর উপজেলার কেশবনগর এলাকায় বীরেন বিশ্বাস (৩৫) ও আবুল হোসেন (৪০) নামে অপর একজন শ্রমিক মারা গেছে কৃষ্ণনগর ইউনিয়নে। ইউপি চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান জানান, মানিকগঞ্জ থেকে কাজ করতে আসেন আবুল হোসেন।

অপরদিকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের জোয়ারের মোড় এলাকায় শতাধিক গাছ ভেঙে রাস্তায় পড়ায় সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যান চলাচল স্বাভাবিক করে। ঝড়ের কারণে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরো জেলা বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন ছিলো।

জেলা প্রশাসনের এনডিসি মনদীপ ঘরাই জানান, নিহত পাঁচ জনের প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়েছে। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবুল কালাম আজাদ জানান, করিম জুট মিলসহ বিভিন্ন এলাকায় আহত ৫০ জনের বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাদের চিকিত্সা দেয়া হচ্ছে।

ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, গতকাল দুপুরে উপজেলার আটঘর ও গট্টি ইউনিয়নে টর্নেডোয় সরকারি-বেসরকারি স্কুল, দোকানসহ প্রায় পাঁচ শতাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। আটঘর ইউপি চেয়ারম্যান মো. শহীদুল ইসলাম খান সোহাগ জানান, ঝড়ে সাড়ুকদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভূমি অফিস, মাদরাসা, মসজিদ ও দোকানসহ বিভিন্ন গ্রামের প্রায় তিন শতাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। গট্টি ইউপি চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান জানান, তার এলাকায় দুই শতাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। ঘর হারা মানুষ খোলা আকাশের নিচে বাস করছেন।

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকালে এক মিনিটের টর্নেডো লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে লৌহজং উপজেলার গাঁওদিয়া গ্রামের শতাধিক বাড়ি ও গাঁওদিয়া বাজারের প্রায় ৫০টি দোকান। অসংখ্য গাছপালা উপড়ে গেছে। আহত হয়েছে অন্তত ৪০ জন। অনেক পরিবার এখন খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। ইউপি স্বাস্থ্য সহকারী কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল জানান, শতাধিক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বেলা ২টা পর্যন্ত ২০ জনকে প্রাথমিক চিকিত্সা দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে জরুরি সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গতকাল হঠাত টর্নেডোয় আরিচা ঘাটের বেশ কিছু ঘর, দোকান-পাট ও গাছ-পালা  লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। আহত হয় ১০/১২ জন। এ সময় পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, আরিচা-কাজিরহাট নৌ রুটে ফেরি-লঞ্চ, নৌকা চলাচল বন্ধ থাকে।

নওগাঁ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, আত্রাই, মহাদেবপুর ও বদলগাছী উপজেলায় বয়ে যাওয়া আকস্মিক টর্নেডোয় ২০ গ্রামে শতাধিক ঘরবাড়ি বিধস্ত হয়েছে। নিহত হয়েছে দুই জন। এরা হলো- মহাদেবপুরের রহট্টা গ্রামের খাদেম আলীর স্ত্রী মনোয়ারা খাতুন (৪০) ও ভাদু মণ্ডলের ছেলে জেহাদ হোসেন (১০)। এরা গাছের নিচে চাপা পড়ে মারা যান। ক্ষতিগ্রস্তরা খোলা আকাশের নিচে বাস করছে।

শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, গতকাল জাজিরা উপজেলার পাইনপাড়া গ্রামে ঝড়ে শতাধিক বসত ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। মঙ্গল মাঝির লঞ্চ ঘাটের ২০টি দোকান বিধ্বস্ত হয়েছে। ঘরের নিচে চাপা পড়ে তিন ব্যক্তি আহত হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল কাদের বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তাদের সহায়তা দেয়া হবে।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গতকাল পৌরসভাসহ পোতাজিয়া, হাবিবুল্লাহনগর ও বেলতৈল ইউনিয়নের ১৭ গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মাত্র ৫ মিনিট স্থায়ী ঝড়ের তাণ্ডবে কমপক্ষে ৫শ বাড়ি ঘর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। আহত হয় প্রায় দেড় শতাধিক। নগরবাড়ি-বগুড়া মহাসড়কের দিলরূবা বাসস্ট্যান্ড সড়কে বিশাল আকৃতির গাছ উপড়ে পড়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, চৌহালীতে টর্নেডোয় কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্তত ১২টি গ্রামের পাঁচ শতাধিক কাঁচা ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত ও ঘরচাপা পড়ে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে। এনায়েতপুর থানার জালালপুর ইউপি চেয়ারম্যান হাজী সুলতান মাহমুদ ও খুকনী ইউপি চেয়ারম্যান মুল্লুক চাঁদ মিয়া জানান, ঝড়ে তাদের এলাকায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। প্রায় ৪ শ’ ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় সবাই খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে।

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, সদর উপজেলা ও গোপালপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে গতকাল টর্নেডোর আঘাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শতাধিক কাঁচা বাড়ি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে, উপড়ে পড়েছে অসংখ্য গাছ-পালা। আহত হয়েছে ১২ জন। সদর আসনের সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিনাত জাহান কাতুলী ও আলোকদিয়ার কয়েকটি গ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন।

পাবনা প্রতিনিধি জানান, গতকাল উপজেলার চার গ্রামে ১০ সেকেন্ডের টর্নেডোয় পাঁচজন আহত হয়েছে। শতাধিক বাড়ি-ঘর, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অসংখ্য গাছ-পালা ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাখাওয়াত হোসেন ক্ষতিগ্রস্তদের তাত্ক্ষণিকভাবে মাথাপিছু দু হাজার টাকা অনুদান প্রদান করেন। আটঘরিয়া উপজেলার তিনটি গ্রামে ঘূর্ণিঝড়ে অর্ধশতাধিক ঘর-বাড়ি ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।