ঝিনাইদহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতি ও গ্রাহক হয়রানি থামছেই না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও ব্যাপক অভিযোগ!

 

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহ আঞ্চলিক পাসর্পোট অফিসে দুর্নীতি ও গ্রাহক হয়রানি থামছে না। পাসপোর্ট অফিসের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। এমনকি নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও গ্রাহক হয়রানির সাথে অফিসের খোদ কর্মকর্তারা জড়িত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। কথিত রয়েছে গ্রাহকদের কাছ থেকে যে টাকা ঘুষ নেয়া হয় সেই টাকা পাসপোর্ট বিভাগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মাসোহারা ভাগ দিতে হয়। তাই তাদের বিরুদ্ধে শত অভিযোগ দিলেও কোনো কাজ হয় না।

সূত্র জানায়, দেশের ৩৩ জেলায় আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস স্থাপনের অংশ হিসেবে ঝিনাইদহ শহরের কোর্টপাড়ায় অফিস ভাড়া নিয়ে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস করা হয়। মাসে অফিস ভাড়া ১৮ হাজার টাকা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ১ লাখ টাকার বেশি, অন্য খরচ প্রায় ৫ হাজার টাকা। মাসে দেড় লাখ টাকা হিসাবে বছরে সরকারের ব্যয় ১৮ লাখ টাকা। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অফিসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এক বছর পর ২০১৪ সালের পয়লা ডিসেম্বর পাসপোর্ট অফিসের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। তবে কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই অনিয়ম আর দুর্নীতির আঁখড়ায় পরিণত হয়েছে ঝিনাইদহ পাসপোর্ট অফিস। কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত সবাই অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত।

প্রতিটি পাসপোর্ট জমা নিতে অতিরিক্ত ২ হাজার টাকার ভাগবাটোয়ারা সবাই পেয়ে থাকে। যার মধ্যে অফিস পায় ১ হাজার টাকা, পুলিশি তদন্ত বাবদ ৯০০ টাকা, সত্যায়িত বাবদ ১০০ টাকা, ফরম পূরণ বাবদ ১০০ টাকা ও দালাল নিজে ৩০০ টাকা পেয়ে থাকে। এছাড়াও কর্তব্যরত আনসার ও কর্মচারীরা যে যেভাবে পারে পাসপোর্ট করতে আসা সাধারণ লোকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অতিরিক্ত টাকা নেয়ার বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। অতিরিক্ত টাকা রাজনৈতিক নেতা ও অফিসের কর্মকর্তাদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়ে থাকে।

শহরের বড় ভাই, ছোট ভাই ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীর নামেও ২০-২৫টা করে পাসপোর্ট জমা নেয়া হয়ে থাকে। এছাড়া গ্রামগঞ্জ থেকে পাসপোর্ট করতে আসা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা-পয়সা ছিনিয়েও নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। আদায়ের অতিরিক্ত টাকার শতকরা ৭০ ভাগ নেন অফিসের লোকজন আর বাকি ৩০ ভাগ টাকা রাখা হয় রাজনৈতিক ও দালালদের জন্য।

সাধারণ গ্রাহকরা আরও জানান, আবেদনপত্রের সাথে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র ও সরকার নির্ধারিত ফি (ব্যাংক চালান) জমা দিয়ে চালানপত্র দেয়ার পরও অফিসের কর্মকর্তারা নানা ধরনের ভুল চিহ্নিত ও তা সংশোধন করে অন্যদিন জমা দেয়ার কথা বলে চ্যানেল ফি না দেয়া গ্রাহকদের বিদায় করে দেন। পাসপোর্টের আবেদন ফরমের পেছনে সত্যায়িত করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির বিবরণ উল্লেখ থাকলেও উদ্দেশ্যেমূলকভাবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সত্যায়ন লাগবে বলেও আবেদনকারীকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। অফিস থেকে বেরিয়ে এলেই আবেদনকারীকে ঘিরে ধরে দালালচক্রের ৩-৪ সদস্য। এছাড়াও দালালদের দৌরাত্ম্য ও গ্রাহক ভোগান্তি তো নিত্যদিনের ঘটনা। অতিরিক্ত টাকা ছাড়া পাসপোর্ট পাওয়া খুবই দুঃসাধ্য। দালাল ছাড়া কোনো পাসপোর্টের আবেদনও গ্রহণ করা হয় না। ঝিনাইদহ পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০টি আবেদনপত্র জমা পড়ে। ডেলিভারিও হয় সমপরিমাণ।

পুলিশ তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়ে যাওয়ার পরও বর্তমানে অফিসে শতাধিক আবেদন পড়ে থাকে। আর সকল কার্যক্রম শেষ হয়ে যাওয়ার পরও কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে পড়ে আছে আড়ইশত পাসপোর্ট। পাসপোর্ট ফরম পূরণ করে আনলেও দালাল ছাড়া অফিসে জমা নেয়া হয় না।

অফিস কর্তৃপক্ষ প্রসেস হয়ে আসতে বলেন (দালাল হয়ে)। আর দালাল ছাড়া অনুনয়-বিনয় করে জমা দিলেও তাতে হাজারো ভুল বের করে আবেদন বাতিল করে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত পাসপোর্ট বিতরণের সময় থাকলেও দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত তা বিতরণ করা হয়। বর্তমানে এসব দুর্নীতি করেনি করেই থেকে থাকেনি অফিসের উপপরিচালক আব্দুল মোতালেব। তিনি নিজ অফিসে অফিস সহকারী রোকসানা পারভীনকে কুপ্রস্তাব দেয়া দেন। যা নিয়ে জেলা জুড়ে হইচই পড়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। ঝিনাইদহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট উপসহকারী পরিচালক আব্দুল মোতালেব ও সহকারী হিসাবরক্ষক আলপিন নাহারের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী দালালচক্র। দালালরা অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে।

মোবাইল বা অন্যভাবে সঙ্কেত পেয়ে আবেদনকারীকে তারা পাকড়াও করে। সাধারণভাবে জমা হওয়া প্রতিটি পাসপোর্টের আবেদনপত্রে জন্ম সনদ, বয়স বিভ্রান্তিসহ সত্যায়নে ভুল নির্ণয়ের মাধ্যমে নিযুক্ত দালালচক্রের মাধ্যমে ফি আদায় করছেন। এছাড়াও দালাল মারফত টাকা দিলে স্বামীর উপস্থিতি ছাড়াই সত্যায়ন করে পারিবারিক পাসপোর্ট দেয়া হচ্ছে অবাধে। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর সত্যিকার পরিচয় থেকে যাচ্ছে অন্ধকারে।

এ বিষয়ে ঝিনাইদহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল মোতালেব জানান, কোনো ধরনের অতিরিক্ত টাকা নেয়া হয় না এবং অফিসের ভেতরে কোনো দালাল প্রবেশ করতে পারে না। বাইরে দালালদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। পাসর্পোট অফিসের দুর্নীতি ও অনিয়ম সম্পর্কে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মাহবুব আলম তালুদারের সাথে যোগাযোগ হলে তিনি জানান, এ ব্যাপারে আমি অবগত নয়। তবে বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখবো।