ঝিনাইদহে হাসপাতালে চাকরি না করেই বেতন ভাতা তোলা যায় বছরের পর বছর

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: কোনো কাজ করেন না। অথচ প্রতি মাসের শেষে ঠিকই বেতন ভাতা তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। নেই কোনো বাধা, তাইতো মাসের পর মাস বছর ধরে নিজ কর্মস্থলে থাকছেন না কালীগঞ্জ হাসপাতালের একাধিক ডাক্তার ও নার্সসহ অনেকই। তারা ‘ডেপুটেশন’ নামের এক তেলেসমাতী কাগজের বদৌলতে যোগদানস্থলে কাজ করবেন না বলে অন্য শহরে চলে গেছেন। কিন্তু বাস্তবে সেখানেও নামমাত্র স্বাক্ষর দেখিয়ে ওই ডাক্তারগণ ব্যক্তিগত চেম্বার ও বিভিন্ন ক্লিনিকে দাপিয়ে বেড়ান। এদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে কালীগঞ্জের ৫০ শয্যার হাসপাতাল ও গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোর বেহাল দশায় এখন তারা নিজেরাই রোগী হয়ে গেছেন। ধারাবাহিক এই অনিয়মের মধ্যেই ভেঙে পড়েছে উপজেলার স্বাস্থ্য সেবার মেরুদণ্ড। তবে নাম না প্রকাশে ডাক্তারদের কেউ কেউ বলেছে এমন অনিয়মের চিত্র নাকি দেশের সব উপজেলা সদরেই চলছে।

সরেজমিনে গিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলার স্বাস্থ্য সেবার এক চিত্রে দেখা গেছে, ৫০ শয্যার এ হাসপাতালটিতে ডাক্তার থাকার কথা ২১ জন, কিন্তু কাগজে কলমে আছেন মাত্র ৭ জন ডাক্তার। সেই ৭ জনের খোঁজ নিয়ে বাস্তবে দেখা গেছে কর্মক্ষেত্রে ডাক্তার আছেন ৫ জন। বাকি দুজন ডা. আলাউদ্দিন ও ডা. নাহিদুল ইসলাম ডেপুটেশন কাগজ নিয়ে রয়েছেন ঝিনাইদহ শহরে। কিন্তু তারা মাসে মাসে ঠিকই এই হাসপাতালে এসে স্বাক্ষর করে বেতন ভাতা তুলে নিয়ে যান।

ডাক্তারদের দেখাদেখি একই পন্থায় এ হাসপাতালের ৩ নার্স প্রভাব খাটিয়ে থেকে গেছেন বড় জেলা সদরে। এদের মধ্যে নার্স হালিমা খাতুন ও লক্ষীরাণী রয়েছেন ঝিনাইদহ সদরে এবং শাহানাজ পারভীন রয়েছেন যশোর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। তারাও কাজ না করে মাসে মাসে এসে বেতন তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এসব বিষয়ে কেউ কেউ বলেছে বাইরে থাকা ওইসব ডাক্তার নার্সদের উপরি মহলে ব্যাপক খুঁটির জোর রয়েছে। সেই ক্ষমতার জোরেই তারা নাকি ডেপুটেশন নামের এক তেলেসমাতি কাগজ করেছেন। যার বদৌলতে মাসের পর বছর হাসপাতালে না আসলেও তাদের কোনো সমস্যা হয় না।

এ হাসপাতালে যোগদান করার পর ’ডেপুটেশন’ কাগজ নিয়ে বাইরে থাকলেও হাসপাতালে এসে বেতন তুলে নিচ্ছেন, এমন বিষয়ে জানতে কথা বললে ডা. নাহিদুল ইসলাম ও আলাউদ্দিন জানান, কালীগঞ্জ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অপারেশনের রোগী কম হয়। তাই জেলা সিভিল সার্জন মহোদয় তাদের জেলাতে নিয়ে এসেছেন। আর ডাক্তারদের মতই বাইরে থাকা নার্স হালিমা খাতুন জানান, বাচ্চাদের স্কুল ও পারিবারিক কারণে তিনি ডেপুটেশন নিয়ে ঝিনাইদহে আছেন, অপরজন লক্ষীরাণী বিশ্বাসের মুঠোফোনে যোগাযোগ করলেও তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

এখানেই শেষ নয়। তাদের মতই এই হাসপাতালের কম্পাউন্ডার ওবাইদুল হক, ইসিজি ম্যান ইমরান সরকার ও এ্যানেস্থিয়া ডাক্তার আসেন না প্রায় বছর ধরে। কিন্তু তারাও মাসের শেষে বেতন ভাতা তুলে নিয়ে যান। এরপরও থেকেও নেই এক্সরে মেশিন ম্যান, ৬ মাস শূন্য স্টোর কিপারের পদ, নেই জেনারেটর ও লাশ রাখা ঘর। সব মিলিয়ে কালীগঞ্জ হাসপাতালটি এখন নিজেই রোগী হয়ে গেছে।

এরপরও আরও বেহাল অবস্থায় রয়েছে উপজেলার দুটি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ ১১ কমিউনিটি ক্লিনিক। এদের ১১ জন ডাক্তারের মধ্যে আছেন মাত্র ৩ জন, বাকি ৮ পদ শূন্য রয়েছে। আবার এই ৩ জনের মধ্যেই ১ জন ডা. গত ২ বছর আগে বলরামপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগদানের পরদিন সেই যে চলে গেছেন, আর ফিরে আসেনি। আর ১১ ইউনিয়নে ১১ জন মেডিকেল অ্যাসিস্টেনট (সেকমো) এর মধ্যে ৫ জনই রয়েছেন বড় জেলা শহরে।

এদের মধ্যে ইয়াসমিন আরা রয়েছেন কুষ্টিয়ার মিরপুরে, জয়নাল আবেদিন কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে, তাসলিমা খাতুন কুষ্টিয়া বক্ষব্যাধি হাসপাতালে, মাহাবুবার রহমান ঝিনাইদহের হরিনাকুণ্ডু ও সালাউদ্দিন রয়েছেন ঝিনাইদহের সাধুহাটিতে। এরাও কাজ না করে প্রতি মাসে বেতন ভাতা তুলে নিচ্ছেন। তবে কাজ না করেই মাস বছরের পর বছর বেতন ভাতা তুলে নেয়ার পেছনে এদের সবারই রয়েছে ডেপুটেশন নামের এক তেলেসমাতী রক্ষাকবজ। আর বিশেষ স্বার্থেই সেই রক্ষাকবজের সাপোর্ট দিয়ে থাকেন উপরি মহলের কিছু বড় কর্তারা। যে কারণে কাজ না করেই সহজে পার পেয়ে যাচ্ছেন তারা।

মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্টদের মধ্যে ডেপুটেশন নিয়ে বাইরে কুষ্টিয়ার মিরপুরে থাকা জয়নাল আবেদিন জানান, তার স্ত্রী ও একই চাকরি করেন, আর ছোট ছেলে মেয়ে বৃদ্ধ বাবা মা পরিবারের দেখাশোনার জন্য তিনি ডেপুটেশন নিয়ে সেখানে আছেন। আর হরিনাকুণ্ডুতে ডেপুটেশন যাওয়া মাহবুবার রহমান বলেন, কি কারণে ডেপুটেশন নিয়েছি তা আপনাকে বলা যাবে না বললেও তিনি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থেকে প্রতিদিন হরিনাকুণ্ডুতে এসে অফিস করেন বলে জানান।

এদিকে ঝিনাইদহ সদরে ডেপুটেশনে যাওয়া মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট সালাউদ্দিন বলেছেন, তাকে জেলা সিভিল সার্জন মহোদয় সদরে পোস্টিং দিয়ে এনেছেন, আর কুষ্টিয়ার মিরপুরে থাকা ইয়াসমিন আরার ব্যক্তিগত মোবাইলফোনটি বন্ধ থাকায় তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে এদের প্রায়  সবাই পারিবারিক সমস্যা দেখিয়ে ডেপুটেশন নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এমন নানাবিধ সমস্যার বেড়াজালে আটকে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার স্বাস্থ্য সেবার হাল বড়ই নাজুক অবস্থায় আছে।

এসব বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. প্রফুল্য কুমার জানান, ডাক্তার, নার্স ও জনবলসহ নানাবিধ সঙ্কটে সেবাদান কিছুটা সমস্যা হয়ে থাকে। তবে এ হাসপাতালে পোস্টিং নিয়ে যারা বাইরে আছেন, তারা ডেপুটেশনে থাকায় তিনি তাদেরকে কিছু বলতে পারেন না।

‘ডেপুটেশন’ কাগজ সংক্রান্ত বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা সিভিল সার্জন ডা. রাসেদা খাতুন বলেন, ঢাকার ডি জি অফিস থেকে ডেপুটেশন অর্ডার কাগজ নিয়ে কেউ কেউ বাইরে পোস্টিং নিয়ে কাজ করছেন। তবে এমন বিষয় নিয়ে বা অন্য কোনো সমস্যার কথা জানিয়ে উপজেলা সদরের হাসপাতালের স্বাথ্য কমিটি যদি কোনো রেজুলেশন দেন, তাহলে তিনি অবশ্যই ব্যাবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান।

হাসপাতাল স্বাস্থ্য কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ও স্থানীয় এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার জানান, তিনি ইতোমধ্যে হাসপাতালটির সকল সমস্যা লিখিতভাবে জানতে চেয়েছেন এবং গত স্বাস্থ্য কমিটির মাসিক সভাতে আর কাউকে ডেপুটেশন দেয়া বন্ধসহ তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে সকল ব্যাবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন।