ঝিনাইদহে ভূমি অফিস ঘুষ-দুর্নীতির খোলাবাজার

 

 

ঝিনাইদহ অফিস: ঘুষ-দুর্নীতির হাট বসেছে ঝিনাইদহের ভূমি অফিসগুলোয়। কোনো রাখঢাক ছাড়া প্রকাশ্যে চলছে ঘুষ লেনদেন। এখানে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। নড়ে না ফাইল। ভূমি অফিসে সরেজমিন অবস্থান করে দেখা গেছে, ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি, হয়রানি ও ঘুষ বাণিজ্যের ভয়াবহ চিত্র।

সব ভূমি অফিস দালাল পরিবেষ্টিত। তাদের কাছে কোনো কাজই অসাধ্য নয়। জমির বৈধ মালিক যেই হোক, চাহিদামতো টাকা এবং দাগ খতিয়ান নম্বর দিলেই তা হয়ে যায় অন্যের। আবার বৈধ কোনো কাজে গিয়েও প্রকৃত ভূমি মালিকদের হতে হয় হয়রানির শিকার। নামজারির জন্য যেখানে সরকার নির্ধারিত ফি ২৪৫ টাকা, সেখানে ৫ হাজার টাকার নিচে কোনো কাজে হাতই দেয় না কেউ। প্রত্যেকটা ভূমি অফিসে দালালের উৎপাতে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। দালাল-কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই মিলে গড়ে তুলেছে বিরাট সিন্ডিকেট। কোনো লুকোচুরি নেই, কোনো লাজলজ্জা, ভয়ভীতির বালাই নেই। এমনভাবে ঘুষের দরদাম করা হয় যেন এ তাদের ন্যায্য পাওনা। দাবি মতো টাকা দিলে তদন্ত প্রতিবেদন, সার্ভে রিপোর্ট আর নামজারি খতিয়ানের মাধ্যমে গোপনে একজনের জমি রাতারাতি হয়ে যাচ্ছে অন্যজনের নামে। এসব অনিয়মের বেড়াজালে প্রতিনিয়ত সর্বস্বান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। জাল দলিল, পর্চা, মৌজা ম্যাপ (নকশা), একই জমি বহুজনের কাছে বিক্রি, রেকর্ডের সময় নির্ধারিত লোকের অনুপস্থিতিতে তার জমি নিজের অংশের মধ্যে ঢোকানোসহ নানা ধরনের দুর্নীতির সাথে পরিচিত ভুক্তভোগীরা।

ঝিনাইদহ পৌর ভূমি অফিসে আসা ষাটোর্ধ্ব ছবদুল ইসলাম বলেন, ভূমি অফিসের দেয়ালও ঘুষ খায়। তহশিলদার ও কর্মচারীরা দিনে কয় লাখ টাকা যে ঘুষ নেয় আল্লাহ জানে। ওপরের কর্মকর্তাদের কাছেও এর ভাগ যায়। নামজারি করাতে গেলে সরকার নির্ধারিত ফি ২৪৫ টাকা। পৌর ভূমি অফিসে নামজারি করতে আসা প্রায় প্রত্যেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা এবং অনেকে এর চেয়েও বেশি দিয়েছেন। আরও বেশি হয়রানির ভয়ে এরা নাম প্রকাশে রাজি হননি। পৌর ভূমি অফিসের তহশিলদার রফিকুল ইসলাম ঘুষ নিচ্ছেন প্রকাশ্যে। সবকিছুই জানা সবার। তারপরও কোনো প্রতিকার নেই। প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেনের এমন দৃশ্য দেখলে মনে হবে এযেন সর্ষের মধ্যে ভূত।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা ভূমি অফিসের নাজির মোশাররফ হোসেন কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। ঘুষের টাকায় জমি কিনেছেন শহরের একাধিক জায়গায়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। দাবিকৃত টাকা না দিলে তিনি মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করেন বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। ভূমি সংক্রান্ত কাজে আসা লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভূমি অফিসটিতে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। টাকা না দিলে নানা অজুহাত দেখিয়ে সাধারণ লোকজনকে মারাত্মকভাবে হয়রানি করা হয়। সরকারি নিয়োগকৃত কর্মচারীর চেয়ে বাইরের দালালের সংখ্যা বেশি।

এ অফিসের ভেতরে অবস্থান করে দেখা যায়, প্রতিটি ডেস্কে রয়েছে টাকার হিসাব করার জন্য ক্যালকুলেটর। প্রত্যেক কর্মচারী ঘুষ লেনদেন করতে দেখা যায়। অত্র ভূমি অফিসের কর্মচারীদের ঘুষের লেনদেন করতে দেখা গেছে। একটি সূত্র জানায়, এ অফিসে প্রতি মাসে ২০ লাখ টাকার বেশি ঘুষের লেনদেন হয়ে থাকে। এ টাকার ভাগ যায় উচ্চ পর্যায়েও।

ঝিনাইদহ শহরের হামদহ ঘোষপাড়া এলাকার শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র ঘোষ অভিযোগ করেন, শরিকগণের সাথে ভাগ বাটোয়ারার জন্য ঝিনাইদহ সাব জজ ১ আদালতে ৩৫ জনকে বিবাদী করে একটি মামলা করেন তিনি। এর মধ্যে ১ নং বিবাদী মৃত তারাপদ ঘোষের ছেলে তপন ঘোষ ২৯ নং বিবাদী নরেন্দ্র নাথ ঘোষ, ৩০ ও ৩২নং বিবাদী গোলাম মোস্তফা এবং ৩৪ ও ৩৫নং বিবাদী নওশের আলীর সাথে মামলা হয়। এরপর থেকে আমি আমার প্রাপ্ত জমি ভোগদখল ও খাজনা দিয়ে আসছি। ঝিনাইদহ নিম্ন তফশিল অফিসে জমি নিতাই পদ ঘোষ ২৮০/৬৪-৬৫ নং মিসকেস প্রজার ওয়ারেশ হিসাবে আমি ৬২১/১২ নং জমি পত্তন করি এবং খাজনা পরিশোধ করে সব জমি ভোগ দখল করছি। কিন্তু ঝিনাইদহ পৌর ভূমি অফিসের তহশিলদার রফিকুল ইসলাম এবং সহকারী কমিশনার ভূমি অফিসের নাজির মোশাররফ হোসেন ২৯নং বিবাদী নরেন ঘোষের সাথে যোগসাজোশ করে মিস মামলাটি বাতিল করে দেন। তিনি আরও বলেন, বিবাদী নরেণ ঘোষের ছেলে অরুণ ঘোষ অফিসে টাকা দিয়া আমার নাম পত্তন বাতিল করেছেন। অরুণ ঘোষ ক্ষিপ্ত হয়ে ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে ছেলে ও আমাকে আমার ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান থেকে তুলে নিয়ে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। একই সাথে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করছে তারা। এসব ঘটনায় ভূমি অফিসের নাজির মোশাররফ হোসেনের ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ করেন কার্ত্তিক ঘোষ।

তবে ঝিনাইদহ সহকারী কমিশনার ভূমি অফিসের নাজির মোশাররফ হোসেন ও পৌর ভূমি অফিসের তহশিলদার রফিকুল ইসলাম এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।