ঝিনাইদহে ভুয়া মালিক সেজে জমি বিক্রি করছে একটি চক্র : সঙ্ঘবদ্ধ চক্রেচুয়াডাঙ্গার ছেলে

 

চুয়াডাঙ্গার সালেহীন সোহাগ ওরফে কাজী আবু হাসান গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে চক্রের চাঞ্চল্যকর তথ্য

 

শাহনেওয়াজ খান সুমন: ঝিনাইদহে এক শ্রেণির প্রতারকচক্র ভুয়া মালিক সেজে জমি বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছে। এতে করে প্রকৃত মালিকদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। রোববার দুপুরে চুয়াডাঙ্গা শহরের মসজিদপাড়ার লিয়াকত হোসেনের ছেলে সালেহীন সোহাগ ওরফে কাজী আবু হাসান গ্রেফতার হওয়ার পর বেরিয়ে এসেছে এ চক্রের চাঞ্চল্যকর তথ্য। চক্রটি ভুয়া মালিক সেজে ঝিনাইদহ সাব রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তিদের জমি বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এতো দিন চক্রটির নাগাল পায়নি। এ ধরনের ঘটনার সাথে সংশ্লি¬ষ্ট সাব রেজিস্ট্রি অফিসের অসৎ কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছে। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দাউদ হোসেন ও মামলার তদন্তকারী এস.আই মো. আনোয়ার হোসেন এ খবর নিশ্চিত করেছেন।

জানা গেছে, সম্প্রতি ঝিনাইদহ জেলা শহরের চাকলাপাড়ার শাহিনা আক্তার লোনা অর্ধ কোটি টাকার বিনিময়ে সুজিত কুমার সাহা নামের এক প্রতারকের কাছ থেকে সাড়ে ১১ শতক জমি ক্রয় করেন। অথচ ওই জমি স্থানীয় একটি ব্যাংকের কাছে বন্ধক দেয়া ছিলো। জেলা রেজিস্ট্রারের দফতর সূত্রে জানা যায়, ওই জমির প্রকৃত মালিক জেলা শহরের আরাপপুর গ্রামের নুর আলমের ছেলে সাইফুল আলম। অপরদিকে সদর উপজেলার পুটিয়া গ্রামের মৃত আবুল হোসেনের ছেলে মো. রফিকুল ইসলাম ও তার মেয়ে যুথি খাতুন ৮ লাখ টাকা দিয়ে ভুটিয়ারগাতি মৌজায় ৫ শতক জমি ক্রয় করেন। ভুয়া মালিক সেজে ওই জমি বিক্রি করেন গ্রেফতার হওয়া সালেহীন সোহাগ ওরফে কাজী আবু হাসান। এ ব্যাপারে থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।

পুলিশ জানায়, এ জমির প্রকৃত মালিক ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কোদালিয়া গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নানের ছোট ছেলে আবু হাসান ওরফে হারুন। তিনি এখন ঢাকায় বসবাস করেন। ঝিনাইদহ সদর উপজেলা সাব রেজিস্টার আবুল বাশার গত ১০ এপ্রিল ২৯৯০নং কবলা দলিলটি রেজিস্ট্রি করেন। লোনার জমির দলিল লেখক ছিলেন মো. আনোয়ারুল ইসলাম (লাইসেন্স নং-৭১) এবং মো. রফিকুল ইসলাম ও তার মেয়ে যুথি খাতুনের কবলা দলিলের লেখক হলো ফিরোজ আহম্মদ (লাইসেন্স নং ১৪৯)। শাহিনা আক্তার লোনা অতিরিক্ত ১০ লাখ টাকা খরচ করে জমির মালিক হয়েছেন। কিন্তু দরিদ্র রফিকুল ইসলাম ও তার মেয়ে পথে বসেছেন। থানা পুলিশের কাছে মাথা ঠুকে ঠুকে কাঁদছেন তারা।

প্রতারক চক্রটি সুকৌশলে ঢাকায় বসবাস করা কিংবা প্রবাসীদের জমির কাগজপত্র তৈরি করে থাকে। এরপর তারা দালালদের মাধ্যমে ক্রেতা সংগ্রহ করে প্রথমে একটি ভূয়া বায়না নামা প্রস্তুত করে দেয়। তহশিল অফিস ও উপজেলা ভূমি অফিসের দাখিলা, নামজারি এবং জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে অবিকল নকল দলিলসহ কাগজপত্র সংগ্রহ করে প্রতারকচক্রের সদস্যরা। দীর্ঘ সময় নিয়ে তৈরি করা কাগজপত্র দিয়ে সুযোগ বুঝে সাব রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে ক্রেতার অনুকূল জমি রেজিস্ট্রি করে দেয় তারা। সংশ্লিষ্ট সাব রেজিস্টার নির্ধারিত অঙ্কের ঘুষের টাকা পকেটে ভরেন এবং নিজ ক্ষমতা বলে জমি রেজিস্ট্রি করে দেন। শুধু তাই নয় এক মাসের মধ্যে দলিলের কপি পেয়ে যান ক্রেতা। যে কারণে প্রতারণার বিষয়টি ক্রেতা বুঝতে পারেন না। জমি কিংবা বাড়ির প্রকৃত মালিক কিছুই টের পাননা। ভুয়া কাগজপত্র মূলে জমির ক্রয় সূত্রে নতুন মালিক হন তিনি। যখন দখলে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তখন ঘটনা জানাজানি হয়ে পড়ে। এ সময় হই চই পড়ে যায়। চক্রটির সাথে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী চরমপন্থি নেতারা জড়িত। কোনো কোনো সময় চরমপন্থি দলের নামে টেলিফোনে জমির প্রকৃত মালিককে হুমকি দেয়া হয়। পাড়ার মাস্তানরা ছুটে আসে। বাড়তি রোজগারের আশায় তারও তৎপর হয়ে ওঠে। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছুই করার থাকে না। হতাশ হয়ে পড়েন প্রকৃত মালিক।

সূত্র জানায়, হরিণাকুণ্ডু উপজেলাতেও অনুরুপ একাধিক ঘটনা ঘটেছে। জেলা শহরের লোন কোম্পানির কোটি কোটি টাকার অফিস বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। অভিযোগ উঠেছে ভুয়া মালিক সেজে কবলা দলিল মুলে দখল প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে ওই সম্পত্তি। এসব ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পরে একাধিক দলিল লেখককের লাইসেন্স সাময়িকভাবে বাতিল করা হয়েছে। জড়িত অন্যদের বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে গেছে। কিন্তু বিধি হলো বাম! পুলিশ প্রতারকচক্রের অন্যতম প্রধান চুয়াডাঙ্গার সালেহীন সোহাগকে গ্রেফতার করার পর ঝোলার বিড়াল বের হয়ে পড়ে।

পুলিশের প্রথমিক তদন্তে বেরিয়ে পড়েছে কতিপয় দলিললেখক এবং সাব রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারীর নাম। সূত্র মতে, প্রতারকচক্রের প্রধান ঝিনাইদহ শহরের কথিত কমিউনিস্ট রণজিত দাস ও তার ছেলে বিশ্বজিত দাস, চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের মসজিদপাড়ার লিয়াকত হোসেনের ছেলে সালেহীন সোহাগ ওরফে কাজী আবু হাসান, দলিল লেখক সমিতির সদস্য ফিরোজ আহম্মেদ (লাইসেন্স নং- ১৪৯), মো. ফরিদ উদ্দিন এবং ভুটিয়ারগাতি গ্রামের মো. বাবুল মিয়ার নাম জানতে পেরেছে পুলিশ। প্রতারকচক্রটির সাথে আরো অনেকে জড়িত রয়েছে বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে। এদের মধ্যে রোববারের অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে সালেহীন সোহাগওরফে কাজী আবু হাসান। আত্মগোপন করেছেন বাকিরা।

পুলিশ বলেছে, চক্রটির সাথে জড়িত দুজন দলিল লেখকসহ বাকি সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সদর উপজেলা সাব রেজিস্টার আবুল বাশার আগেই প্রতারণার খবরের সত্যতা স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন, জাল দলিল ঠেকানোর কোনো আইন তার জানা নেই। তিনি জোর দিয়ে বলেন, যেকোনো দলিলের কাগজপত্র জাল হলে সংশ্লিষ্ট দলিল লেখক এবং ক্রেতা বিক্রেতা দায়ী থাকবেন। জাল দলিল হলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে।