জীবননগরে সেবা ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোমে ভুল চিকিৎসায় স্কুলছাত্রী মৃত্যুপথযাত্রী

 

জীবননগর ব্যুরো: ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার প্রবাদটি একেবারেই মিলে গেছে জীবননগরের সেবা ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোমের ক্ষেত্রে। নিয়ম অনুযায়ী ১০ শয্যার অনুমোদিত কোনো ক্লিনিকের জন্য একজন নিয়মিত চিকিৎসক, সার্জন ও ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী সেবিকা থাকার কথা থাকলেও জীবননগর সেবা ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোমে নিয়মিত কোনো চিকিৎসক ও সার্জন নেই। নেই অস্ত্রোপচারের উপযুক্ত ব্যবস্থা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াই এ ক্লিনিকে অবৈধভাবে সব ধরনের জটিল অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে। দালালদের এক থেকে দেড় হাজার টাকা কমিশন দিয়ে রোগী সংগ্রহ করে ভর্তি করিয়ে অস্ত্রোপচার করে গ্রামের সাধারণ মানুষের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। এখানে সেবা নিতে এসে চিকিৎসকের ভুল অস্ত্রোপচারসহ ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতির কারণে মত্যুর সাথে লড়তে হয়েছে অনেক রোগীকে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু তদারকি না থাকায় গ্রামের অসহায় শ শ রোগী দালালচক্রের মাধ্যমে এখানে চিকিৎসা নিতে এসে প্রাণ দিচ্ছেন অহরহ এমনটা মনে করছেন সচেতনমহল। শাকিলা খাতুন নামের এক কিশোরীর ভুল চিকিৎসার খোঁজখবর নিতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এসব নানা তথ্য। অভিযোগ রয়েছে, এর আগেও বেশ কয়েকজন রোগী এ ক্লিনিকে ভর্তি হওয়ার পর চিকিৎসকের ভুল অস্ত্রোপচার করার কারণে রোগী ও রোগীর লোককে ভোগান্তি পোয়াতে হয়েছে। সম্প্রতি এক রোগীর ভুল অস্ত্রোপচার করার কারণে আদালতে মামলা হওয়ায় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরে মাধ্যমে ৫৫ হাজার টাকায় রোগীর স্বজনদের সাথে আপস-মীমাংসা করে। সেবা ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোম বন্ধ ও ভুল অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসকের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া গ্রামের মো. সাহাদৎ হোসেনের মেয়ে শাকিলা খাতুন (১৫) উথলী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যলয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী। শাকিলা ছোট থেকেই তার মামা উথলী গ্রামের সেলিম হোসেনরে বাড়ি থেকে পড়ালেখা করতো। গত ৩০ জুলাই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শাকিলা পেটে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে তার মামা সেলিম হোসেনের সাথে জীবননগরের সেবা ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোমে চিকিৎসা নিতে যায়। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ রোগীর আল্ট্রাসনোগ্রাফি করার পর বলে যে, তার অ্যাপেন্ডিসাইট রোগ ধরা পড়েছে। রোগীর অস্ত্রোপচার করাতে হবে। এমতাবস্থায় রোগীর মামা অস্ত্রোপচার করার অনুমতি দিলে মা, শিশু স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রের (এমওএমসিএইচএফপি) মেডিকেল অফিসার মো. গোলাম রহমানের তত্ত্বাবধানে শাকিলার অস্ত্রোপচার করা হয়। এদিকে অস্ত্রোপচার করার পরদিন থেকেই রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। সেখানে ২০ দিন থাকার পরেও তার পেটে ব্যথা কমেনি। ব্যথা না কমায় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানালে তারা বলে, রোগীকে বাড়িতে নিয়ে যান ওষুধ খাওয়ান ঠিক হয়ে যাবে। শাকিলাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কয়েক দিনে রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। এই অবস্থায় ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মুমূর্ষু অবস্থায় শাকিলা খাতুনকে তার স্বজনরা চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক মো. ওয়ালিউর রহমান নয়নের কাছে নিয়ে যান। চিকিৎসক রোগী দেখে বলেন, অস্ত্রোপচারের স্থানে পচন ধরেছে। দ্রুত অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। ২৬ সেপ্টেম্বর সার্জারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. ওয়ালিউর রহমান নয়ন তার অস্ত্রোপচার করে রোগীর পেটের মধ্য থেকে প্রায় দেড় ফুট লম্বা একটি গজ বের করেন এবং তিনি বলেন, শাকিলার আগের অস্ত্রোপচার ভুল ছিলো। চিকিৎসক অ্যাপেন্ডিস না কেটে তার পেটের অন্য একটি নাড়ি (অন্ত্র) কেটে ফেলেছেন। সেখান থেকে মল বের হয়ে ক্ষতস্থানে পচন ধরেছে। পরবর্তীতে রোগীর আরও ২টি বড় অস্ত্রোপচার করতে হবে। তবে রোগীর অবস্থা খুবই সঙ্কটাপন্ন।

শাকিলার পিতা শাহাদত হোসেন জানান, তার মেয়ের অ্যাপেন্ডিসাইটের ব্যথার জন্য ক্লিনিকে ভর্তি করলে ডাক্তার জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করেন। ভালো হওয়া তো দূরের কথা এখন সে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। তিনি অভিযোগ করেন, ডাক্তার ভুল চিকিৎসা দিয়ে তার মেয়েকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। শাকিলার মামা সেলিম হোসেন জানান, এ ব্যাপারে জীবননগর সেবা ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোম ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি চলছে। জীবননগরে সেবা ক্লিনিক অ্যান্ড নার্সিং হোমের মালিক শিল্পু জানান, রোগীর স্বজনদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আপস-মীমাংসার করার চেষ্টা চলছে।

জীবননগর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাহমুদা খাতুন বলেন, ডা. মো. গোলাম রহমান বর্তমানে নেত্রকোনা জেলায় মা, শিশু স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রের (এমওএমসিএইচএফপি) মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এর আগে ডা. মো. গোলাম রহমান মহেশপুর উপজেলায় কর্মরত থাকাকালীন ভুল চিকিৎসায় এক রোগী মেরে ফেলার কারণে আদালতে মামলা হলে তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয় নেত্রকোনা জেলায়। নেত্রকোনা জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপপরিচালক গোলাম মোহাম্মদ আজমের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ডা. গোলাম রহমান এখানে যোগদানের পর একদিনও অফিস করেননি। এ কারণে তার বিরুদ্ধে ঢাকা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে পরপর দুটি অভিযোগ করা হয়েছে।

জীবননগর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নূরুল হাফিজ জানান, কোনো ক্লিনিকে অবৈধ কিছু ঘটলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. মো. সিদ্দিকুর রহমানের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ ধরনের কোনো কাজ ওই ক্লিনিকে ঘটলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে অভিযুক্ত চিকিৎসক গোলাম রহমানের বক্তব্য নেয়ার জন্য তার মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।