জীবননগরে সারের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে বস্তাপ্রতি সাড়ে ৫শ টাকা পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধি

আমন আবাদের পরিণতি ভেবে শঙ্কিত কৃষক ॥ ভ্রাম্যমাণ আদালতে দুজনকে অর্থদন্ড
জীবননগর ব্যুরো: জীবননগর উপজেলার উথলী গ্রামের বর্গাচাষি হাসেম আলী উচ্চমূল্যে সার কিনতে না পেরে এখনো আমনক্ষেতে সার প্রয়োগ করতে পারেননি। ভেবেছিলেন চারা রোপণের ক’দিন পর টাকা জোগাড় করে জমিতে সার দেবেন। কিন্তু তিনি ভাবেননি সরকারের বেধে দেয়া ১১০০ টাকা বস্তা টিএসপি সার ১৬৫০ টাকা মূল্যে কিনতে হবে। উপজেলার অনন্তপুর গ্রামের কৃষক মফিজুল হক (৫০) জানান, তিনি ইতোমধ্যেই ৭০ শতক জমিতে আমন ধানের চারা লাগিয়েছেন। অন্যান্য বছর প্রতি একরে পটাশ সার (এমওপি) ২০ থেকে ২৫ কেজি ও সমপরিমাণ টিএসপি সার প্রয়োগ করে চারা লাগাতেন। ফলন ভালো হতো। এবার প্রতি কেজি টিএসপি সারের দাম ৩৫ টাকা শুনে আর কিনতে যাননি। ওই দামে সার কেনা তার মতো ছোট কৃষকের সঙ্গতি হবে না। ফলে একরে ৮-১০ মণ ধান কম হবে বলে তার আশঙ্কা। সার বিক্রয় ব্যবস্থা মনিটরিং ও বিপণন ব্যবস্থার দুর্বলতাই সারের মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ বলে তিনি জানিয়েছেন।
কৃষকরা অভিযোগ করেন, উপজেলার অধিক মুনাফালোভী কিছু অসাধু খুচরা সার বিক্রেতারা সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সরকারের বেধে দেয়া ৮শ টাকা মূল্যের প্রতি বস্তা ইউরিয়া সার ৯০০ টাকা, ১১০০ টাকা মূল্যের টিএসপি সার (ট্রিপল সুপার ফসফেট) ১৭৫০ টাকা এবং ১২৫০ টাকা মূল্যের প্রতিবস্তা ডিএপি সার (ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট) ১৬৫০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। কৃষকদের দাবি খুচরা বিক্রেতারা চাহিদা অনুযায়ী সার না পাওয়া ও সারের ঘাটতির কথা বলে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
এদিকে খুচরা সার বিক্রেতারা অভিযোগ করেছেন, বিসিআইসি অনুমোদিত জীবননগর উপজেলার সার ব্যবসায়ীদের ঘরে প্রচুর সার মজুদ থাকলেও আরও দাম বৃদ্ধির আশায় বাজারে কৃত্রিম সার সংকট দেখানো হচ্ছে। এতে করে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। উপজেলার উথলী বাসস্ট্যান্ডের আরিফ ট্রেডার্সের মালিক আরিফুর রহমান জানান, উপজেলার বিসিআইসির (বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন) সার ডিলাররা সরকারের ভর্তুকির সার অবৈধভাবে বেশি দামে তাদের কাছে বিক্রি করছেন। ডিলাররা সংকটের ধুয়া তুলে সরকারের বেধে দেয়া ৮শ টাকা মূল্যেরে প্রতি বস্তা ইউরিয়া ৮৫০ টাকা টাকা, ১১০০ টাকা মূল্যের টিএসপি সার ১৫৭০ টাকা এবং ১২৫০ টাকা মূল্যের প্রতিবস্তা ডিএপি সার ১৬৩০ টাকা দরে তাদের কাছে বিক্রি করছেন। তিনি আরো জানান, বিসিআইসি অনুমোদিত উপজেলার অধিকাংশ সার ডিলার নিজেরা সার না তুলে প্রতিমাসে সার উত্তোলনপত্র খুচরা সার ব্যবসায়ীদের কাছে অধিক মূল্যে বিক্রি করে দেন। বেশি দামে সার বিক্রি করলেও তাদেরকে কোনো রসিদ দিচ্ছেন না। বেশি দামে সার কেনার কারণে বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এ সময় তিনি মেসার্স রাসেল এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স নূর ইসলামের কাছ থেকে সার কেনার উত্তোলনপত্র দেখান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উথলী বাজারের এক খুচরা সার বিক্রেতা জানান, তিনি উথলী বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত জহিরের দোকার থেকে পাইকারি হিসেবে সরকার নির্ধারিত ৮০০ টাকা মূল্যের প্রতিবস্তা ইউরিয়া সার ৮৪৫ টাকা দরে কিনেছেন। কাশিপুর বাজারের খুচরা সার ব্যবসায়ী শুকুর সরকার জানান, উপজেলার বিসিআইসির সার ডিলাররা সিন্ডিকেট তৈরি করে গত দু মাস থেকে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সারের দাম বস্তাপ্রতি ৫০ টাকা থেকে সাড়ে ৭শ টাকা পর্যন্ত বেশি নিচ্ছেন। এতে সরকারের চরম দুর্নাম হচ্ছে।
সার উত্তোলনের চালানপত্র বেশি দামে বিক্রির বিষয়ে বিসিআইসি অনুমোদিত সার ডিলার মেসার্স নূর ইসলামের স্বত্বাধিকারী নূর ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সঠিক দামে সার বিক্রি করলেও খুচরা ব্যবসায়ীরা বেশি দামে বিক্রি করছেন। আপনি হাসাদাহ ইউনিয়নের অনুমোদিত ডিলার হয়ে কেন উথলী ইউনিয়নের খুচরা ব্যবসায়ীর কাছে সার বিক্রি করলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা ভুল হয়েছে।
এসব অনিয়মের ব্যাপারে জানতে চাইলে জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, সরকার নির্ধারিত মূল্যের বেশি দামে কেউ সার বিক্রি করলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অবৈধ মজুদ ও চড়ামূল্যে সার বিক্রির দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে দু ব্যবসায়ীকে অর্থদন্ড: ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে মজুদ গড়ে তুলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার নির্ধারিত মূল্যে থেকে চড়া দামে রাসায়নিক সার বিক্রির দায়ে জীবননগরে ভ্রাম্যমাণ আদালতে দু সার ব্যবসায়ীর সার জব্দ এবং তাদেরকে অর্থদন্ডেদন্ডিত করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে উথলী মোড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকালে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ পাওয়ায় আদালতের বিচারক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা এ আদেশ প্রদান করেন।
আদালত সূত্রে জানা যায়, সরকার নির্ধারিত মূল্যে উপজেলার কৃষকদের রাসায়নিক সার পাওয়ার কথা থাকলেও উপজেলার কৃষকরা তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকার নির্ধারিত প্রতিবস্তা ইউরিয়া সারের খুচরা বাজার মূল্য ৮০০ টাকা হলেও এখানে বিক্রি করা হচ্ছে ৯০০ টাকা দরে। একইভাবে প্রতিবস্তা টিএসপি ১১০০ টাকার স্থলে ১৭৫০ টাকা এবং ডিএপি ১২৫০ টাকার স্থলে ১৬৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। অভিযোগ পেয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত উপজেলার উথলী মোড় অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানকালে অবৈধভাবে দোকানে ইউরিয়া সার মজুদ করার অপরাধে আরিফ ট্রেডার্স থেকে ২০ বস্তা ইউরিয়া সার জব্দসহ এর মালিক আরিফুল রহমানকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা ও রানা ট্রেডার্স থেকে ১৬ বস্তা ইউরিয়া সার জব্দসহ তাকেও ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। উপজেলা কৃষি অফিসার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ও এসআই আব্দুল হাই ভ্রাম্যমাণ আদালতকে এ সময় সহযোগিতা করেন। এ অভিযান অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছেন কৃষকরা এবং প্রতিটি সারের দোকোনে সরকার নির্ধারিত সারের মূল্য তালিকা টানানোর দাবি জানিয়েছেন।