জামায়াত নেতা মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড

স্টাফ রিপোর্টার: মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গতকাল জনাকীর্ণ আদালতে রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের  নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২। ট্রাইব্যুনালের অপর দু সদস্য হলেন বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের তিন দিন পর দলটির ডাকা টানা হরতালের হুমকির মধ্যেই এ রায় ঘোষিত হলো। ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের এ সদস্যের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়। একটি অভিযোগে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ ৬ জনকে হত্যার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে তিন বিচারক সর্বসম্মত প্রাণদণ্ডের রায় দিলেও ১২ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির সিদ্ধান্ত হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত অন্য আটটি অভিযোগে সর্বমোট ৭২ বছরের কারাদণ্ড ও চারটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়। রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, আইনমন্ত্রী, গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠন সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, মিথ্যা মামলায় মিথ্যা সাক্ষীর ভিত্তিতে এ রায় দেয়া হয়েছে। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। রায় শুনে মীর কাসেম আলী প্রতিক্রিয়ায় বলেন, মিথ্যা সাক্ষীতে মিথ্যা রায়। শিগগির সত্যের জয় হবে। এদিকে মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে আগামী বৃহস্পতিবার আবারও হরতালের ডাক দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।

এদিকে রায়ের জন্য আসামি মীর কাসেমকে শুক্রবারই কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়। রোববার সকালে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পুলিশের একটি প্রিজনভ্যানে করে কড়া নিড়াপত্তায় ট্রাইব্যুনালে আনা হয়।
প্রসঙ্গত মানবতাবিরোধী অপরাধে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এটি একাদশতম রায়। এর আগে দুটি ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত ১০টি রায়ে মোট ১১ জন মানবাতবিরোধী অপরাধী মৃত্যুদণ্ড, আজীবন কারাবাস ও যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত হয়েছেন। তাদের প্রায় সবাই বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ স্থানীয় নেতা।
সকাল সাড়ে ১০টার আগেই রায় শুনতে গণমাধ্যমকর্মী, প্রসিকিউশনের আইনজীবী, আসামিপক্ষের আইনজীবী সহ সাংস্কৃতিক কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক সবাই এসে জড়ো হন ট্রাইব্যুনালে। ১০টা ৫২ মিনিটে বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম ট্রাইব্যুনালে তাদের নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেন। স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল ২-এর এ রায়টি ট্রাইব্যুনালে-১ এ ঘোষণা করেন তিন বিচারপতি। এর আগে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে মামলার আসামি মীর কাসেম আলীকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় হাজির করে আইনশৃঙ্খরা বাহিনী। কালো প্যান্ট, নীল রঙের শার্টের ওপর ঘিয়ে রঙের কোট পরিহিত মীর কাসেম কাঠগড়গড়ায় দাঁড়িয়ে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীসহ সবাইকে উচ্চ স্বরে সালাম দেন। এ সময় প্রতিউত্তরে দু’-একজন তার সালামের জবাব দেন। তারও আগে সকাল সাড়ে ৯টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থেকে পুলিশের বিশেষ ভ্যানে করে মীর কাসেম আলীকে কড়া নিরাপত্তায় ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তিনি প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা ট্রাইব্যুনালের কয়েদখানায় ছিলেন। এ সময়টুকু তিনি কয়েদখানায় পায়চারী করে কাটান। সকাল ১০টা ৫৯ মিনিট। ট্রাইব্যুনালে তখন পিনপতন নীরবতা। চেয়ারম্যান বিচাপতি ওবায়দুল হাসান রায় পড়া শুরু করেন। এ সময় তিনি বলেন, ৩৫১ পৃষ্ঠা রায়ের ১১ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত অংশ পড়ে শোনানো হবে। এই বলে তিনি রায় পড়া শুরু করেন।

রায়ে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের কতিপয় সদস্য নিয়ে গঠিত হয়েছিলো আলবদর বাহিনী। এ বাহিনীর একজন শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন এই মামলার আসামি মীর কাসেম আলী। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদী ও দলটির আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের বক্তব্য ও তাদের নেতৃত্বের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে মীর কাসেম আলী আলবদরে যোগ দেন। তিনি এই বাহিনীর একেবারে কমান্ডিং পজিশনে ছিলেন। যা ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপিত তথ্য ও সাক্ষ্য-প্রমাণে উঠে এসেছে। ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষণে বলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের ডালিম হোটেল ছিল এক ভয়াবহ নির্যাতন কেন্দ্র। আলবদর সদস্যরা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের ধরে এনে ডালিম হোটেলে আটকে রাখতো। সেখানে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হতো। এর মধ্যে কোন কোন ব্যক্তিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এই ডালিম হোটেলের ভেতরেই। রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে স্থাপিত এই নির্যাতন কেন্দ্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব ছিল মীর কাসেম আলীর। ওই সময় মীর কাসেম চট্টগ্রাম শহর শাখা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি, আলবদর বাহিনীর নেতা ও নির্দেশদাতা ছিলেন। নির্যাতন ও নির্মমতার মাত্রা এতটাই ছিল যে, তাকে ‘বাংলার খান সাহেব’ হিসেবেও অনেকে উল্লেখ করেছেন। এতে প্রমাণিত হয়, ওই নির্যাতন ক্যাম্পে যারা নির্যাতিত হয়েছেন এবং যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, সবকিছুর পেছনেই মীর কাসেম মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। ট্রাইব্যুনাল পর্যবেক্ষণে বলেন, রায়ে অভিযোগ, দোষী সাব্যস্তকরণ ও শাস্তি তিনটি অংশেই ডালিম হোটেলে নির্যাতনের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। নির্যাতনের আটটি অভিযোগে মীর কাসেম দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, যার প্রতিটিতে কারাদণ্ড সাজা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাকি যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, এই দু’টিতেও ডালিম হোটেলে নির্যাতনের বিষয়টি ছিল। একপর্যায়ে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান মীর কাসেমের সঙ্গে ট্রাইব্যুনালে দাখিলকৃত অভিযোগ ও এর সঙ্গে মীর কাসেমের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি পড়ে শোনান। মাত্র ৩০ মিনিটের ঘোষিত রায়ে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বেলা সাড়ে এগারটায় অভিযুক্ত মীর কাসেমের বিরুদ্ধে দণ্ড দান সম্পর্কিত বিষয়টি পড়ে শোনান। মীর কাসেমের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিলকৃত ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১১ ও ১২ নম্বর সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়া দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, ২ নম্বর অভিযোগে ২০ বছরের কারাদণ্ড, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০ নম্বর অভিযোগে ৭ বছর করে কারাদণ্ড ও ১৪ নম্বর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ১০ বছর করে সর্বমোট ৭২ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি মর্মে এসব অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১ ও ৫ নম্বর অভিযোগে রাষ্ট্রপক্ষ কোন সাক্ষীকে হাজির ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেনি। তাই এ অভিযোগ থেকে মীর কাসেমকে খালাশ দেয়া হয়।

যেসব অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড: মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে দাখিলকৃত একাদশতম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৮ নভেম্বর পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ ৬ জনকে ধরে নিয়ে চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে নির্যাতন করে হত্যা করে মীর কাসেম ও তার সঙ্গী আল বদররা। সেখানে নির্যাতনে নিহত আরও পাঁচজনের সাথে জসিমের লাশ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেয়া হয়।

দ্বাদশতম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরে নভেম্বর মাসে চট্টগ্রামের হিন্দু অধ্যুষিত হাজারী গলির বাসা থেকে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, রঞ্জিত দাস ওরফে লাতু, টুন্টু সেন ওরফে রাজুকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়। সেখানে লাতু ও রাজুকে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়। রাজাকার, আলবদররা হাজারী গলির ২৫০ থেকে ৩০০ দোকান লুটপাট করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়।