জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা অনুমোদন

 

 

স্টাফ রিপোর্টার: জনস্বার্থবিঘ্নিত হতে পারে এমন কোনো বিদ্রোহ, নৈরাজ্য, হিংসাত্মক ও বিদ্বেষমূলকঘটনা প্রচার না করার বিধান রেখে ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা, ২০১৪’ অনুমোদনদিয়েছে মন্ত্রিসভা। সম্প্রচার নীতিমালা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে গঠিত হবেস্বাধীন সম্প্রচার কমিশন। বেসরকারি টিভি-রেডিওর লাইসেন্স দেয়ার সুপারিশকরবে এই কমিশন। এছাড়া অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রেও রয়েছেসুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা।

সম্প্রচার নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি এবংবেসরকারি মালিকানায় সম্প্রচারমাধ্যম পরিচালনার ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রেখেদেশের সম্প্রচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতেই এটি করা হয়েছে।সম্প্রচার সেক্টরের মাধ্যমে মত প্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেআন্তর্জাতিক নীতি ও মানদণ্ড অনুসরণ, বহুত্ববাদ ও বৈচিত্র্য সমুন্নত রাখা, সঠিকতা, নিরপেক্ষতা ও গণমুখিতা বজায় রাখা এবং তথ্যের অবাধ প্রাপ্তি নিশ্চিতকরা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় নীতিমালায়।

মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত এইনীতিমালা অনুযায়ী, সশস্ত্র বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ করাযাবে না। অপরাধীদের দণ্ড দিতে পারেন এমন সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তিবিনষ্ট করার মতো দৃশ্য বা বক্তব্যও প্রচার করা যাবে না। আর পণ্য ও ভোক্তারঅধিকার রক্ষা করে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হবে।জাতীয় আদর্শের প্রতিবিদ্রুপ করে কোনো সংবাদ বা অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না। বিচ্ছিন্নতা ওঅসন্তোষ সৃষ্টি, ব্যক্তির প্রাইভেসি, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, ধর্মীয় মূল্যবোধক্ষতিগ্রস্ত করে এমন বিষয়ে সংবাদ বা অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না।

প্রধানমন্ত্রীশেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষেমন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিবমোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি বলেন, কাজের ক্ষেত্রেসম্প্রচার কমিশন হবে স্বাধীন। সম্প্রচার নীতিমালা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নেস্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন করা হবে। পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে আইন করার কথাবলা হয়েছে নীতিমালায়। স্বাধীন এ কমিশন সম্প্রচার নীতিমালা বাস্তবায়নে কোডঅব গাইডেন্স গঠন করবে। নীতিমালা অনুযায়ী লাইসেন্স দেয়ার সুপারিশও করবেকমিশন।

সার্চ কমিটির মাধ্যমে সম্প্রচার কমিশনের চেয়ারম্যান বা প্রধাননির্ধারণ করা হবে বলে জানান সচিব। তিনি বলেন, সাংবাদিক, গণযোগাযোগ ওসাংবাদিকতা বিষয়ের শিক্ষক, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে কমিশন গঠিত হবে।সম্প্রচার নীতিমালা ও কমিশনের জারি করা নিয়মাবলি যথাযথভাবে প্রতিপালিতহচ্ছে কিনা, তা পরিবীক্ষণ করবে কমিশন। সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের কোনোঅনুষ্ঠান, সংবাদ বা বিজ্ঞাপন যাতে কোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত ক্ষতির কারণ নাহয় সে বিষয়টি মনিটরিং করবে কমিশন।
নীতিমালায় বলা হয়, সামাজিক দায়বদ্ধতা, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচারকরবে। সম্প্রচারে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিএবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও সামাজিক মূল্যবোধ নীতিমালায় সমুন্নতরাখতে বলা হয়েছে। নীতিমালার আলোকে সম্প্রচার কমিশন এবং এ সম্পর্কিত আইন করাহবে। তবে কমিশন ও আইন না হওয়া পর্যন্ত সম্প্রচারসম্পর্কিত নীতিমালাবাস্তবায়নে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। কমিশন গঠনের পর আইনের মাধ্যমেস্বাধীনভাবে কাজ করবে। নীতিমালায় বলা হয়, বেতার ও টেলিভিশনসহ সম্প্রচারমাধ্যমকে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের ভাষণসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানযথাযথভাবে প্রচার করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সব প্রচার মাধ্যমই এইনীতিমালা মেনে চলবে।

বিজ্ঞাপন প্রচার: সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেদেশবিরোধী বা জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে।বিজ্ঞাপনে প্রতিযোগী পণ্যের তুলনা বা নিন্দা করে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা যাবেনা। সংবাদের আকারে বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। অনুষ্ঠান থেকে বিজ্ঞাপনভিন্নতর হতে হবে। নাটক বা কোনো অনুষ্ঠানের ভেতরে বিজ্ঞাপন বা বিজ্ঞাপনেরবিষয়বস্তু প্রত্যক্ষ করা যাবে না। বিজ্ঞাপনে এমন কোনো দাবি করা যাবে নাযাতে জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতারিত হতে পারে। রাষ্ট্রীয়ভাবেসংরক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ ভবন, স্থাপনা, কার্যালয় যেমন- জাতীয় সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, কোর্ট বা আদালত, আদালতেরকার্যক্রম, সেনানিবাস এলাকা, শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি কোনোপণ্যের বিজ্ঞাপনচিত্রে প্রদর্শন করা যাবে না। মহান স্বাধীনতা দিবস, মুক্তিযুদ্ধ, গণঅভ্যুত্থান, ভাষা আন্দোলন ইত্যাদি পর্যায়ের বিষয়গুলোরমর্যাদা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে এ বিষয়গুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেবিজ্ঞাপনচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। মডেলদের পোশাক-পরিচ্ছদ শালীন হতেহবে।

মহিলাদের বক্ষ বর্ধন, পুরুষ ও মহিলাদের বা শিশু-কিশোরদের স্লিমিং, ওজন হ্রাস অথবা সীমিতকরণ, ফিগার নিয়ন্ত্রণের জন্য অননুমোদিত ওষুধপত্র অথবাচিকিৎসা, যৌন দুর্বলতা, অকাল বার্ধক্য ইত্যাদি বিষয়ক চিকিৎসা, স্বপ্নেপ্রাপ্ত ওষুধ, মাদুলি, কবজ, জাদু ইত্যাদির বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবেনা। এলকোহল মিশ্রিত পণ্য এবং নেশাজাতীয় পণ্যের (এলকোহলের পরিমাণ যাই হোকনা কেন) বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না।

যেসব অনুষ্ঠান ও সংবাদ প্রচার করাযাবে না: জাতীয় আদর্শের প্রতি বিদ্রুপ করে কোনো সংবাদ বা অনুষ্ঠান প্রচারকরা যাবে না। কোনো জনগোষ্ঠীর মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন সংবাদ ও অনুষ্ঠানপ্রচার করা যাবে না। দুর্নীতির প্রতি সহানুভূতির সৃষ্টি হয় এমন সংবাদ বাঅনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে না। বিদেশি রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কোনো সংবাদপ্রকাশ করা যাবে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন ধরনেরসামরিক বা সরকারি গোপন তথ্য ফাঁস হয়- এমন সংবাদ প্রচার করা যাবে না।

অনুসরণীয়মানদণ্ড: মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখা, ভাষা-সংস্কৃতি মূল্যবোধসমুন্নত রাখা, জাতীয় শোক দিবস ১৫ আগস্ট, স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ, শহীদদিবস ২১ ফেব্রুয়ারিসহ জাতীয় দিবসের সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে।সরকারি বেসরকারি সব সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য এই নীতিমালা অনুসরণীয় হবে।মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, সাতটি অধ্যায়ে এই নীতিমালা প্রস্তুত করা হয়েছে।তিনি বলেন, অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে স্বাধীন ও অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতেএই সম্প্রচার নীতিমালা শক্তিশালী ও সুন্দর হয়েছে।

অভিযোগ ও নিষ্পত্তি:যেকোনো সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের কোনো অনুষ্ঠান বা সংবাদ যদি কোনো নাগরিকবা প্রতিষ্ঠানের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে তা হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সম্প্রচার কমিশনেরকাছে অনুষ্ঠান প্রচারের ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ দাখিল করতে পারবে। সম্প্রচারকমিশন প্রাপ্ত অভিযোগ সরেজমিনে তদন্ত করে ও উভয় পক্ষের শুনানি করেনিষ্পত্তির ব্যবস্থা করবে এবং সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে। অভিযোগপ্রমাণিত হলে সরকার আইন/বিধি দ্বারা নির্ধারিত শাস্তির বিধান করতে পারবে।

এইনীতিমালার মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হবে কিনা- সাংবাদিকদেরএমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘মোটেও না, বাংলাদেশেসংবাদপত্রের স্বাধীনতার একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আছে। বাংলাদেশে সংবাদপত্রেরস্বাধীনতা একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর আরও উন্নয়নের জন্যইএ নীতিমালা।’নীতিমালা সম্প্রচারমাধ্যমকে সংকুচিত করবে না:জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা বিকাশমান সম্প্রচারমাধ্যমকে সংকুচিত করবে নাবলে জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা, ২০১৪’-এরখসড়া অনুমোদনের পর সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তথ্যমন্ত্রী।বিকাশমানসম্প্রচারমাধ্যমকে গতিশীল করার জন্য সম্প্রচার নীতিমালা করা হয়েছে জানিয়েতথ্যমন্ত্রী বলেন, গণমাধ্যমকে সংকুচিত করার জন্য নীতিমালা করা হয়নি।বিদ্যমান যেসব আইনে সম্প্রচার গণমাধ্যম পরিচালিত হচ্ছে সেগুলো সমন্বিত করেনীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। গত কয়েকদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘গণমাধ্যমকেনিয়ন্ত্রণের জন্য’ সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে যে সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে তাসঠিক নয়, দাবি করে ইনু বলেন- সম্প্রচারমাধ্যমকে একটি গতিশীল ব্যবস্থারমধ্যে নিয়ে আসার জন্য এই নীতিমালা করা হয়েছে।

সম্প্রচার নীতিমালাকেযুগান্তকারী পদক্ষেপ উল্লেখ করে হাসানুল হক ইনু বলেন, এটা গণমাধ্যম জগতেনতুন দিন উন্মোচনকারী পদক্ষেপ। নাগরিক স্বাধীনতার পাশাপাশি সাংবাদিকদেরঅবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। আগামী ৪৮ঘণ্টার মধ্যে গেজেট প্রকাশ করা হবে জানিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, এরপর আইন তৈরিএবং সম্প্রচার কমিশন গঠন করা হবে। কতো দিনের মধ্যে আইন তৈরি হবে জানতেচাইলে মন্ত্রী বলেন, কয়েক মাস সময় লাগবে।