জনবল সমস্যা আর দুর্নীতির বেড়াজালে আবদ্ধ চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল

স্টাফ রিপোর্টার: জনবল সঙ্কট আর নানা অনিয়মের কারণে ধুঁকে ধুঁকে চলছে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল। এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে দুর্নীতি। ফলে অনিয়মই এখানে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি বিধি মেনে চলেন না কোনো চিকিৎসক। বিধি-বিধান তোয়াক্কা করেন না কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নার্সরা। সবই যেন গা সওয়া হয়ে গেছে রোগী সাধারণের। বহির্বিভাগে রোগীর লম্বা লাইন থাকলেও চিকিৎসক থাকেন প্রাইভেট প্র্যাকটিসে। এ দৃশ্য নিত্যদিনের হলেও কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথা নেই। সর্বোপরি হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়েও ৫০ শয্যার জনবলে জোড়াতালি দিয়ে চলছে কোনো রকম।

১৯৭০ সালে স্থাপিত হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল। সরকার ঘোষিত জন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ২০০৩ সালে হাসপাতালটি ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়। কিন্তু দীর্ঘ এক যুগেও অদৃশ্য কারণে এখানে ১০০ শয্যা হাসপাতালের জনবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। উপরন্তু আড়াইশ’ বেডে উন্নীতকরণের জন্য চলছে অবকাঠামো নির্মাণ। তাছাড়া ৫০ শয্যার জন্য এখানে চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারীসহ অন্যান্য জনবল ১০০ জন থাকার কথা থাকলেও আছে ৮৯ জন। ফলে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে স্বাস্থ্যসেবা। কয়েকদিন আগে আরো জন চিকিৎসক অন্যত্র বদলির আদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন। পলে এ সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত হাসপাতালের বহির্বিভাগ খোলা থাকার কথা থাকলেও বেলা ১টার পর এখানে কাউকে পাওয়া যায় না। টিকিট কাউন্টারগুলো সকাল ৯টার দিকে খোলা হলেও বেলা ১২টার পর টিকিট দেয়া বন্ধ হয়ে যায়। কোনো কোনো চিকিৎসক আসেন বেলা ১১টায়। এ কারণে তাদের কক্ষের সামনে রোগীর লম্বা লাইন পড়ে যায়। জানতে চাইলেই শোনা যায় ‘ডাক্তার সাহেব অফিসিয়াল কাজে রয়েছেন, বা মিটিঙে আছেন।’ অথচ দেখা যায় তিনি বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে ব্যস্ত আছেন। আবার হাসপাতালে চেম্বারে এসেও কিছু কিছু চিকিৎসক ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি ও দালালদের সাথে খোশ গল্পে মেতে ওঠেন। ফলে বিশেষ সুবিধা নিয়ে হাসপাতালের ওষুধ বাদ রেখে ব্যবস্থাপত্রে কোম্পানির ওষুধ লেখেন তারা। অনেক সময় হাসপাতালে ওষুধ থাকা সত্ত্বেও নার্সরা রোগীর লোকদের হাতে এভাবে ওষুধের ফর্দ ধরিয়ে দেন। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ নার্স সময়মতো ডিউটিতে আসেন না। কেউ কেউ আধাঘণ্টা দেরিতে হাসপাতালে ঢোকেন। জরুরি বিভাগেও ভিড় করে থাকেন ওষুধ কোম্পানির লোকজন। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের এ দৃশ্য প্রতিদিনের। ফলে তা রোগী সাধারণের গা সওয়া হয়ে গেছে। রোগীরা সরকারি ওষুধ না পেলেও দেখা যায় বছর শেষে মেয়াদোত্তীর্ণ অনেক ওষুধ পুড়িয়ে ফেলে কর্তৃপক্ষ। তবে বরাদ্দ আসা দামি দামি ওষুধগুলো হাসপাতালে আসতে না আসতেই রহস্যজনকভাবে ফুরিয়ে যায়। এর কারণ অবশ্য সাধারণ মানুষ কেউই জানে না। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক রোগী বলেন ‌‘গত রোববার হাসপাতালের টিকেট কেটে চিকিৎসককে দেখাই। ডাক্তার তার শর্টস্লিপে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ লেখেন। কিন্তু ওষুধ বিতরণ কেন্দ্রে গেলে জানানো হয় ওষুধ ফুরিয়ে গেছে।’ পরে ওষুধ বঞ্চিত রোগীরা সিভিল সার্জনের কাছে নালিশ করতে যেতে চাইলে ওষুধ দেয়া হয়।

আন্তঃবিভাগেও রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি। হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে সারা বছর চলে অর্থ বাণিজ্য। এখানে প্রসব ব্যথা নিয়ে ভর্তি হওয়া মহিলা রোগীদের কাছে মিষ্টি খাওয়ার নাম করে জোরপূর্বক আদায় করা হয় এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। বিশেষ রাতের বেলায় টাকা আদায়ের ঘটনা বেশি হয়। চিকিৎসকদের কাছে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয় না। কোনো সময় কর্তৃপক্ষ লিখিত অভিযোগ দিতে বলে ভুক্তভোগীদের। ঝামেলা এড়ানোর জন্য কেউ আর অভিযোগ করে না। বছরের পর বছর এ অবস্থা চললেও অজ্ঞাত কারণে অভিযুক্ত নার্স ও আয়াদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। নার্সরা অন্যসব ওয়ার্ডের ইনচার্জ হতে না চাইলেও গাইনি ওয়ার্ডে যাওয়ার জন্য সবাই হুড়োহুড়ি করেন।

ফিমেল মেডিসিন ওয়ার্ডের ইনচার্জ বিভা লাহিড়ীর বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগ। কিছু কিছু ওষুধ বরাদ্দ থাকলেও তিনি রোগীকে দেন না। অভিযোগকারীরা জানান, তিনি প্রয়োজনীয় ওষুধ দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবিকার কাছে না দিয়ে স্টোর রুম তালাবদ্ধ করে রাখেন। সরকারিভাবে সরবরাহকৃত ক্যানোলা তিনি কাউকেই দেন না। রোগীদের প্রশ্ন তাহলে সেগুলো যায় কোথায়?

সরকারি বিধি তোয়াক্কা না করে রোগীদের খাবার সরবরাহ করা হয়। দেখা যায়, খাবার যেমন নিম্নমানের, তেমনি পরিমাণেও কম। খাবার চুরি রোধে কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

খাবার সরবরাহকারী ঠিকাদার ফেরদৌসওয়ারা সুন্না জানান, বিধি মোকাবেক মাথা ও লেজ বাদ দিয়ে আমি হাসপাতালে মাছ সরবরাহ করি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সব খাবার সঠিকভাবে আমার কাছ থেকে বুঝে নেয়। কিন্তু রান্নাঘর থকে কিছু হলে সে দায়তো আমার নয়। অভিযোগ রয়েছে, রান্নাঘর থেকে প্রতিনিয়ত খাবার চুরি হয়। ইতঃপূর্বে রাধুনি সুফিয়া কয়েকবার খাবার চুরির সময় হাতেনাতে ধরাও পড়েছেন। হাসপাতালের চাল, কাঁচা মাছ, মাংস, সবজি, তেল ও মসলাপাতি চুয়াডাঙ্গা কয়েকটি হোটেলে বিক্রি করা হয় বলেও জনশ্রতি রয়েছে।

রোগী সাধারণের অভিযোগ, সঠিক তদারকির অভাবে হাসপাতালের যেখানে সেখানে পড়ে থাকে নোংরা আর ময়লা-আবর্জনা। তাই দুর্গন্ধের কারণে নাকে রুমাল দিয়ে কোনো কোনো ওয়ার্ডে রোগীর লোকদের ঢুকতে দেখা যায়। অনুসন্ধানে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদের হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন ও চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন হাসপাতালে ইতঃপূর্বে তদারকি করেন। সেসময় সবকিছু একটা নিয়মের মধ্যে চলেছে। দুর্নীতি ও অনিয়মও বন্ধ ছিলো। কিন্তু ইদানীং তাদের হাসপাতাল পরিদর্শন কমে যাওয়ায় হাসপাতালে বাসা বেঁধেছে অনিয়ম। এ ব্যাপারে হুইপ ছেলুন জোয়ার্দ্দার ও পৌর মেয়র টোটন জোয়ার্দ্দারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ভুক্তভোগীরা।

অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের কেবিন কেউ কেউ বরাদ্দ না নিয়েই রোগী তোলেন। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কেবিনগুলো ফ্রি ব্যবহার করেন অনেক রোগীর লোক। কর্তৃপক্ষ নমনীয় হওয়ায় হরহামেশা এ ধরনের সুযোগ ধরতে দেখা যায় অনেককে। আবাসিক মেডিকেল অফিসারের নমনীয়তার কারণে সরকারকে পড়তে হচ্ছে রাজস্ব ফাঁকিতে। হাসপাতালের এক্স-রে ও ইসিজি বিভাগও দুর্নীতির আখড়া। এখানে অসংখ্য রোগীর এক্স-রে ও ইসিজি করা হলেও খাতা-কলমে দেখানো হয় কম। ফলে টাকা আত্মসাৎ করা সুবিধা হয়। তাছাড়া হাসপাতালে এক্স-রে ইসিজির ব্যবস্থা থাকলেও কোনো কোনো চিকিৎসক রোগী পাঠান বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এসব অব্যবস্থাপনা ও সমস্যা মাথায় নিয়ে আড়াইশ’ শয্যায় উন্নীত হতে যাচ্ছে হাসপাতালটি। এ জন্য অবকাঠামো নির্মাণও চলছে। ২৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে গণপূর্ত বিভাগ আটতলা ভিত বিশিষ্ট ছয়তলা ভবন নির্মাণ করছে। ২০১১ সালে শুরু হওয়া এ ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০১৬ সালে।

নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মাসুদ রানা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, জনবল সমস্যার কারণে রোগীর চাপ সামাল দিতে কিছুটা সমস্যা হয়ে যায়।