জঙ্গি মারজানের মোবাইলফোনে চাঞ্চল্যকর তথ্য

 

স্টাফ রিপোর্টার: আপনাকে আর এলাকায় থাকতে হবে না। ঢাকায় চলে আসুন। মিরপুরে এসেই আমাকে ফোন করবেন। সাদ্দাম, কবিরাজ (আজাদুল), রিয়াজুল, সাকিব মাস্টারসহ অন্যদেরও সাথে নিয়ে আসবেন। এক গাড়িতে আসবেন না। সবাই আমাকে ফোন করবেন না। তাগুতরা (পুলিশ) আমাকে অনুসরণ করছে। গুলশান হামলার অন্যতম সমন্বয়কারী নিহত নুরুল ইসলাম মারজানের মোবাইলফোন থেকে এ ধরনের চাঞ্চল্যকর এসএমএস বার্তা পেয়েছেন গোয়েন্দারা। বিশেষ অ্যাপস ব্যবহার করে গুলশান ও কল্যাণপুরের ঘটনার পর রংপুর বিভাগের কমান্ডার জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব গান্ধীকে এ ধরনের এসএমএস বার্তা দেন মারজান। বিদেশে অবস্থানরত কথিত আইএসের ডাক্তার রোকনকে গুলশান হামলার আগে প্রস্তুত করা পাঁচ জঙ্গির ১৪ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডের ভিডিওবার্তাটি পাঠিয়েছিলেন তিনি। আর গুলশান হামলার রাতে ঘটনা-সংক্রান্ত ঢাকার সব বার্তা মারজানই জানিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত জঙ্গিদের। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

দায়িত্বশীল এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর কল্যাণপুরে জাহাজবাড়িতে সফল অভিযান পরিচালিত হয়। কল্যাণপুরের অভিযানের পরপরই ঢাকার বাইরে থাকা জঙ্গিদের এলাকা থেকে প্রত্যাহার করে নেন মারজান। সবাইকে অতি সতর্কতার সাথে ঢাকায় আসতে বলেন। আর তখন থেকেই মারজানকে নজরদারিতে আনার চেষ্টা চালান গোয়েন্দারা। একের পর এক আস্তানার সন্ধানের পর মারজানও তার অবস্থান ঘন ঘন বদল করেন। এক পর্যায়ে বৃহস্পতিবার রাতে মারজান পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, জঙ্গি মারজানের মোবাইলফোন থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। গুলশান ও কল্যাণপুরের ঘটনার পর মারজান ঢাকার বাইরে থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। হামলার কিছুদিন আগে মারজান উত্তরাঞ্চল সফর করেছিল। ওই সফরকালে গাইবান্ধার কারাগারে বন্দি জঙ্গি তৌফিকুল ইসলাম সবুজ, কুড়িগ্রামের কারাগারে বন্দি ফিরোজ হোসেনসহ চারজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। সম্প্রতি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের আওয়ামী লীগের এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটন খুনের পর দুই জঙ্গি সবুজ ও ফিরোজকে জিজ্ঞাসাবাদে করেন র‌্যাবের গোয়েন্দারা। ওই সময় জিজ্ঞাসাবাদে দুই জঙ্গি মারজানের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি স্বীকার করে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, কারাগারে এসে ‘বাবু’ নামে পরিচয় দিয়ে মারজান সাক্ষাৎ করে যান।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা জানান, গুলশানের হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ায় হামলা এবং কল্যাণপুর জাহাজবাড়িতে আস্তানা সংক্রান্ত তথ্য নিয়মিত বিদেশে পাঠান প্রযুক্তিদক্ষ জঙ্গি কমান্ডার মারজান। অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমচালিত অ্যাপসের মাধ্যমে বার্তাগুলো পাঠিয়েছিলেন। গুলশান হামলার সমন্বয়ক হিসেবে দেশের বাইরে তথ্য পাঠানোর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তার হাতেই ছিল। এমনকি কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের হাতে আটক রাকিবুল হাসান রিগ্যানও এ সংক্রান্ত তথ্য স্বীকার করেন। মারজান ছিলেন গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড নিহত তামিম আহমেদ চৌধুরীর একজন গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শদাতা।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম মানবকণ্ঠকে বলেন, নব্য জেএমবিতে সাত সদস্যের একটি শূরা বোর্ড ছিল, ওই বোর্ডের অন্যতম একজন সদস্য ছিলেন নুরুল ইসলাম মারজান। শূরা বোর্ডে ডাক্তার নজরুল নামে একজন আমির ছিলেন, তাকেও খুন করে মারজানসহ ও অন্য জঙ্গিরা। মনিরুল ইসলাম বলেন, নব্য জেএমবিতে সামরিক কমান্ডারদের মধ্যে আইটি সংক্রান্ত বিষয়ে দক্ষ ছিল মারজান। গুলশান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরের ঘটনাগুলোর তথ্য বিদেশে পাঠাতে মারজান প্রযুক্তি ব্যবহার করে। বিশেষ করে তার হাত দিয়েই দেশে ও বিদেশে ঢাকার হামলা-সংক্রান্ত বার্তা যায়। আর এসব তথ্য পেয়ে পরে কথিত আইএস বাংলাদেশে হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়।

গোয়েন্দাদের তথ্য অনুযায়ী, গুলশান ও কল্যাণপুরের ঘটনার অডিও-ভিডিওবার্তা ঘটনাস্থল থেকে প্রথম মারজানের কাছেই পাঠায় জঙ্গিরা। বিশেষ করে গুলশান হামলার আগেই নিহত পাঁচ জঙ্গির পোশাক পরা অবস্থায় গোপন স্থানে ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল। ১৪ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডের এ ভিডিও সংগ্রহ করে রাখেন মারজান। পরে তা দেশের বাইরে ডাক্তার রোকনের কাছে পাঠিয়েছিলেন। সেই ভিডিও আইএসের সাইট আমাক-এ প্রচার করা হয়েছিল। পরে তা ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ে। নিজ দলের জঙ্গিরা যাতে ধরা না পড়ে, সহজে গোয়েন্দা জাল ভেদ করা যায় এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মারজান। এ জন্য থ্রিমাসহ কয়েকটি অ্যাপস ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায়।

২৪ থেকে ২৬ বছর বয়সী যুবক মারজান ভারি অস্ত্র চালাতে পারদর্শী। সিটিটিসি ইউনিটের হ্যালো অ্যাপসে মারজান সম্পর্কিত এ ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য আসে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ শিক্ষার্থী উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বিচরণ করে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলো। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জের ঠাকুরবাড়ি এলাকার ব্যবসায়ী তৌফিকুল ইসলাম সবুজের কাছে যাতায়াত ছিল মারজানের। প্রায় দুই বছর ধরে মারজান সেখানে যাতায়াত করে। সবুজ ঠাকুরবাড়ি এলাকার মৃত তাজুল ইসলামের ছেলে। সেও জেএমবির নেতা। স্যানিটারি সামগ্রীর ব্যবসার আড়ালে জঙ্গি কার্যক্রমে সে জড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে সবুজ কারাগারে আছে।

কারাগারে বন্দি সবুজকে সম্প্রতি জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে মারজানের গাইবান্ধায় আসা-যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। সবুজ গাইবান্ধা থেকে ১৯৯২ সালে এসএসসি ও পরে এইচএসসি পাস করেন। তারপর দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি পাসের পর ঢাকার তাম্বুল বিল্লাহ নামে একটি মাদরাসায় আরবি শিখতে আসে। আর সেখান থেকে বাড়িতে ফিরে জেএমবির কার্যক্রম শুরু করে। কারাগারে গিয়ে সবুজের সঙ্গে মারজান দেখা করেছেন বলে জানান তিনি। সংশ্লিষ্ট এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের জেএমবির আস্তানায় যাতায়াত ছিল মারজানের। মারজান জঙ্গি সদস্যদের কাউন্সিলিং ও অস্ত্র প্রশিক্ষণও দিত। গোবিন্দগঞ্জের এই আস্তানায় আসা-যাওয়া করত গুলশানে নিহত জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, শোলাকিয়ায় আটকের পর নিহত জঙ্গি শফিউল ইসলাম ডন, বগুড়ার পায়েল ও উজ্জ্বল এবং রাজশাহীতে বন্দুকযুদ্ধে নিহত বাইক হাসান। মারজান সামরিক কমান্ডার ছাড়াও অতিরিক্ত দায়িত্ব (ক্যাশিয়ার) হিসেবে জেএমবির তহবিলের যাবতীয় হিসাব রাখত। তার হাত দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় হামলার আগে ও পরে অর্থ যেত বলেও স্বীকার করেন কারাবন্দি জঙ্গি সবুজ।

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, মারজানসহ তার শূরা বোর্ডের জঙ্গিরা কিলিং মিশনের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ অ্যাপস ব্যবহার করত। তারা নিজেদের অবস্থান গোপন রাখতে ব্যবহার করে হাই এনক্রিপশন পদ্ধতি। এমন কি আদান-প্রদানকৃত তথ্য মুছে ফেলতে সহায়তা নেন লিন্যাক্স অপারেটিং সিস্টেমের। আর জিপিএস ক্যালিব্রেটর পদ্ধতিতে ভুল লোকেশন দিয়ে গোয়েন্দাদের বিভ্রান্তও করেন। কিন্তু দক্ষ গোয়েন্দারা তাদের কৌশল জেনে যাওয়ায় একে একে পরাস্ত হয় জঙ্গিরা।