চড়ুই পাখির অভয় আশ্রম চুয়াডাঙ্গা শহরের একটি বকুলগাছ

আহাদ আলী মোল্লা: চড়ুই পাখির অভয় আশ্রম চুয়াডাঙ্গা শহরের একটি বকুল গাছ। এখানে সাঁঝ হতে না হতে ঝাঁকে ঝাঁকে নামে চড়ুই পাখি। তারা কিচির মিচির ডেকে মাতিয়ে তোলে পুরো তল্লাট। স্থানীয়রা চুপচাপ পাখিদের তামাশা দেখেন। আর পথচারীরা চলতি পথে খানিক থমকে দাঁড়ায়। এতো চড়ুই কোথা থেকে আসে প্রতিদিন?

পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে পল্লির মানুষের। আগান-বাগানে নানা প্রজাতির পাখি সারাদিন ডাকাডাকি করে। পাখির কথা মনে উঠলেই চোখে ভাসে পাড়া-গাঁ আর মাঠঘাট। কিন্তু খোদ জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে চড়ুইদের এই মিতালি দু চোখ না জুড়িয়ে পারেই না। যখন দ্রুতহারে চড়ুইপাখি কমার ফলে জীববৈচিত্রে গুরুতর প্রভাব পড়ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের বাস্তুতন্ত্র। তখন চুয়াডাঙ্গার একটি বকুল গাছে হাজারো চড়ুই আমাদের প্রাণে স্বপ্ন জাগায়। গবেষকরা মনে করেন, যে হারে মোবাইল ব্যবহার বাড়ছে তাতে একদিন বিলুপ্তই হয়ে যাবে চড়ুই। কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে তাদের বংশবৃদ্ধি বা রক্ষার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। না হলে অচিরেই বিরল প্রজাতির তালিকায় চলে যাবে বাংলার অতি পরিচিত এই চড়ুই। এতোসব আশঙ্কা আর হতাশার মধ্যে চুয়াডাঙ্গার বকুল গাছের এ পাখিগুলো গবেষকদের প্রাণে স্পন্দন জাগাবে নিশ্চয়।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল রোডের সাথেই সাইদা সুপার মার্কেট। এ মার্কেটের সামনে রাস্তার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটি মাঝারি বকুল গাছ। গাছটির বয়স বড়জোর বছর দশেক। এ গাছের সাথেই সখ্য গড়ে তুলেছে চড়ুই পাখিরা। গাছের মালিক তানভির রেজা বলেন প্রায় পাঁচ বছর আগে চড়ুই পাখিরা এখানে আসতে শুরু করে। এরপর তাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। দিনদিন তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বেলা ৫টা বাজতে না বাজতেই চড়ুইরা আসতে শুরু করে। এখানে চড়ুই পাখির সংখ্যা কয়েক হাজার হবে। তারা যখন ঝাঁকে ঝাঁকে নামতে শুরু করে রোমাঞ্চকর এক দৃশ্যের অবতারণা হয়। আকর্ষণীয় এ দৃশ্য প্রতিদিনই কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবলোকন করেন। পাতার ফাঁকে ফাঁকে তারা লুকিয়ে পড়ে। যতো না পাতা তত না চড়ুই ওই বকুল গাছে। সন্ধ্যায় চড়ুইদের ভারে গাছটি ন্যুয়ে পড়ে। অনেক চড়ুই বসতে জায়গা পায় না। তাদের কেউ কেউ বিদ্যুতের তারে, পাশের দালানের কার্নিশে ও পার্শ্ববর্তী একটি কদম গাছে আশ্রয় নেয়। হাজার হাজার চড়ুই পাখি কোথা থেকে আসে কেউ জানে না।’ পাখিগুলোকে যাতে কেউ উড়োতাড়া বা শিকার না করে সেজন্য সার্বক্ষণিক নজর রাখেন তানভির রেজা।

ভোর বেলা বকুল গাছটিতে চড়ুই পাখিরা ডাকাডাকি শুরু করে। সে যেন মধুর এক গুঞ্জন। তাদের কিচির মিচির ডাক শুনে অনেক মানুষেরই ঘুম ভাঙে। বেলা ওঠার সাথে সাথে তারা বকুলগাছ ছাড়তে থাকে। ঝাঁক ধরে ধরে আবার কোথায় হারিয়ে যায়। শূন্য হয়ে পড়ে গাছটি। তারপর সাঁঝের আগমনে ফের তাদের আগমন ঘটে। এভাবেই বছরের পর বছর চলে তাদের আসা-যাওয়া।

চড়ুই বা চড়াই যেকোনো লোকালয়ের আশেপাশে একটি সুপরিচিত পাখি। এরা জনবসতির মধ্যে থাকতে ভালোবাসে। তাই এদের ইংরাজি নাম হাউস স্প্যারো অর্থাৎ ‘গৃহস্থালির চড়ুই’। খড়কুটো, শুকনো ঘাস-পাতা দিয়ে কড়িকাঠে, কার্নিশে বা ভাঙা ভেনটিলেটারে এরা বাসা বাঁধে। সমস্ত দিন লাফিয়ে বেড়িয়ে মাটি থেকে পোকামাকড় ও শস্য খুঁটে খায়।

এক সময় গ্রাম বাংলার খড়ের ঘরের মাথায় চড়ুই পাখির নাচানাচি দেখা যেতো। উঠোনে ধান শুকাতে দিলো তাদের উৎপাতও সইতে হতো পল্লি বধূদের। কিন্তু পরিবেশের নানা বিপর্যয়ের ফলে চড়ুই পাখি দ্রুত বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে। আর তাদের এই বিলুপ্তি নিয়ে চিন্তিত বিজ্ঞানী ও পরিবেশসচেতন মানুষেরা। গ্রামের দিকে চড়ুইদের দেখা মিললেও শহরাঞ্চলে সচরাচর সে দৃশ্য প্রায় বিরল। শোনা যায় এ জন্য বেশি দায়ী অপরিকল্পিতভাবে গজে ওঠা ক্রমবর্ধমান মোবাইল টাউয়ার। টাউয়ার থেকে নির্গত ক্রমাগত বিকিরণের ফলে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে এ পাখি। কিন্তু এই হতাশার মধ্যে চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের একটি বকুল গাছে চড়ুই পাখির অবাধ বসবাস আশার সঞ্চার করে বৈকি।