চ্যালেঞ্জিং টার্গেট : কর ভ্যাটের জালসহ বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রত্যাশা

 ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার বাজেট

স্টাফ রিপোর্টার: রাজনৈতিকসংঘাতে চলতি অর্থবছরে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ না হওয়ায় আগামী বছরে তা পুষিয়েনিতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুলমুহিত তার পুরো বাজেট বক্তৃতায় ‘কালোমেঘের আড়ালে সোনালি রেখা’ দেখার মতো অপার সম্ভাবনা, প্রতিশ্রুতির বন্যা, অফুরন্ত আশার বাণী শুনিয়েছেন। তিনিজাতিকে প্রত্যাশার মোড়কে সরকারি কর্মসূচিগুলো ‘হচ্ছে, হবে’ বলেই সীমাবদ্ধরেখেছেন। খুব কম ক্ষেত্রেই তিনি সুনির্দিষ্ট করেছেন। জীবনযাত্রার মানবাড়ানো, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়েছেন। রফতানিমুখী শিল্পে করকমানো, অনুন্নত এলাকায় শিল্প স্থাপনে কর সুবিধা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিদিয়েছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি জাতীয় সংসদে ২০১৪-১৫অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বিশাল ব্যয়ভার নিয়ে আশাবাদীঅর্থমন্ত্রী দেশকে এগিয়ে নিতে উচ্চাভিলাষী বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগ্রহণ করেছেন। অন্যদিকে এবারের বাজেটে কর ও ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হয়েছেব্যাপকভাবে। উপজেলা, জেলা পর্যায়েও এবার করের আওতা সম্প্রসারিত হচ্ছে। নতুননতুন খাতকে মূল্যসংযোজন কর (ভ্যাট) ও করের আওতায় আনা হয়েছে। আগামী বছরথেকে ভ্যাটের আওতা আরও বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। ধনাট্য ব্যক্তিদের কাছ থেকেএবার বাড়তি কর আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাড়ির মালিকদের জন্য ২৫হাজার টাকার বেশি হলে ব্যাংকেরমাধ্যমে বাড়ি ভাড়া আদায়ের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হচ্ছে। ব্যাংক জমা বাড়িভাড়া থেকেই সরকার আনুপাতিক হারে কর কেটে রাখবে। অনগ্রসর এলাকার যেসবকোম্পানি কর সুবিধা পায় না সেসব কোম্পানিকে করের আওতায় আনা হয়েছে। বিভিন্নখাতে সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে। পরিবেশ দূষণ করে এমন শিল্প পণ্যের ওপর ১শতাংশ হারে গ্রিন ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে। বিড়ি-সিগারেটের ওপর নিয়মিতশুল্কের বাইরে ১ শতাংশ হারে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে।বিভিন্ন খাতে এবার ভ্যাটের হারও বাড়ানো হয়েছে। এতে দ্রব্যমূল্য আরও বেড়েযাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব মিলে এবারের বাজেটে সারা দেশে কর ও ভ্যটের জালছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেছেন, অব্যাহত সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণকার্যক্রম জোরদার করার প্রয়াসও অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি করখাতে কিছুপ্রণোদনা, কর্পোরেট কর হার কমানোসহ কিছু সুবিধার কথা বলেছেন। বলেছেনশিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে সুদের হার কমানোর কথা। সরকারিভাবে ভৌতঅবকাঠামোখাতে অর্থায়নের ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি। যাতে বেসরকারি খাতেরউদ্যোক্তারা বিনিয়োগের পরিবেশ ও অবকাঠামো সুবিধাদি পায়। চলমান সংস্কারঅব্যাহত রাখারও অঙ্গীকার করেছেন তিনি। এসব ভালোকাজ করতে গিয়ে সার্বিকভাবেব্যয়ভার বাড়িয়ে তুলেছেন। ফলে, চ্যালেঞ্জিং টার্গেট বাস্তবায়নের দায় তারকাঁধে রয়েই গেলো।

অর্থমন্ত্রী আগামী বছরের জন্য মোট ২ লাখ ৫০ হাজার৫০৬ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য স্থির করেছেন। এ ব্যয় করতে গিয়ে আয়েরলক্ষ্যও তাকে বাড়াতে হয়েছে। আয়ের লক্ষ্য স্থির করেছেন ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৫৪কোটি টাকা। সামগ্রিকভাবে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা।অবকাঠামো যেমন বিদ্যুত-জ্বালানি, ভৌত অবকাঠামো প্রভৃতি খাতে ব্যয়ওবেড়েছে। অগ্রাধিকার হিসাবে পদ্মা সেতু খাতে ৮ হাজার ১শকোটি টাকা বরাদ্দরাখা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধির তীব্রআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। ব্যবসা-ব্যয় হরাসের জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয়প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে তিনি ব্যক্তিখাতেঋণপ্রবাহ বাড়িয়ে সুদের হার কমানোর পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ, রফতানি বাড়াতে কিছু খাতে অতিরিক্তপ্রণোদনার কথা বলেছেন। অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন, সামাজিক সুরক্ষা খাতেবিদ্যমান সুবিধাদি আগামীতেও অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।এসবসুবিধাদি নিশ্চিত করতে রাজস্ব আয়ের চাপ বাড়িয়েছেন তিনি। বেশকিছু খাতে মূল্যসংযোজন কর বা ভ্যাট আরোপ, উৎসে করারোপ করা হয়েছে। কিছু খাতে প্যাকেজভ্যাট সুবিধা চালু থাকলেও আগামী বছর থেকে প্রমাণ হারে অর্থাত ১৫ শতাংশহারে ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করেছেন তিনি। পাশাপাশি পরোক্ষ করনির্ভরতাওবাড়িয়েছেন। ফলে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের চাপ সাধারণ জনগণের ওপর যথারীতিথাকছেই। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের অব্যাহত চাপের মুখে সংরক্ষণবাদী নীতি থেকেসরে আসার প্রক্রিয়ায় ঢালাওভাবে ৭৭০টি পণ্যের ওপর আরোপিত সম্পূরক শুল্কহারেপরিবর্তন করা হয়েছে। সম্পূরক শুল্ক হার কমিয়ে ফেলায় দেশীয় শিল্পেরপ্রতিযোগিতাসক্ষমতা অর্জন জরুরি হয়ে দাঁড়াবে।

বাজেটে আয়ের প্রাক্কলন: আগামীবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১ লাখ ৮২হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। এরমধ্যে এনবিআরসূত্রে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটিটাকা, এনবিআর বহির্ভূত কর খাত থেকে ৫ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা আয়ের প্রাক্কলনকরা হয়েছে। কর বহির্ভূত খাত থেকে আরো ২৭ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা আহরণেরলক্ষ্য স্থির করেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে চলতি বছরে রাজস্ব আয় কাঙ্ক্ষিত নাহওয়ার পেছনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবকে দায়ী করা হয়েছে। আগামী বছরে এইআয় বাড়লেও লক্ষ্য অর্জনের চ্যালেঞ্জ থাকছে।

উন্নয়ন বরাদ্দ: বার্ষিকউন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাবরের মতই অবকাঠামো, শিক্ষা ও সামাজিক খাতে গুরুত্বদেয়া হয়েছে। আঞ্চলিক সমতার বিষয়টিও এবারে গুরুত্ব পেয়েছে অর্থমন্ত্রীরবাজেট বক্তৃতায়। মোট ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকার এডিপির মধ্যে মানবসম্পদখাতে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ, সার্বিক কৃষিখাতে ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ, বিদ্যুতজ্বালানি খাতে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ, যোগাযোগ খাতে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবংঅন্যান্য খাতে সোয়া ১২ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ঘাটতি অর্থায়ন: ঘাটতিঅর্থায়নের জন্য বরাবরই অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উত্স থেকে প্রাপ্তির আশাকরেছেন অর্থমন্ত্রী। মোট জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ ঘাটতি মেটাতে গিয়ে বৈদেশিকউত্স থেকে ২৪ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা প্রত্যাশা করেছেন। যদিও চলতি বছরেবৈদেশিক উত্স থেকে কাঙ্ক্ষিত সাহায্য মেলেনি। একইভাবে অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে৪৩ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা সংগ্রহের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। এই টাকারমধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেয়া হবে ৩১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র ওঅন্যান্য খাত থেকে আসবে ১২ হাজার ৫৬ কোটি টাকা।

ঘাটতি অর্থায়নেরজন্য সাধারণত এ তিনটি উত্স থেকে আশা করা হলে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই বেশিঋণ নিতে হয় সরকারকে। এই ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যায়। চলতিবছরেও তাই হয়েছে।

সংশোধিত বাজেট: চলতি অর্থবছরে (২০১৩-২০১৪)মূল বাজেটে সর্বমোট সরকারি ব্যয়ের প্রাক্কলন ছিলো ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটিটাকা। যা সংশোধিত বাজেটে ৬ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা হরাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২লাখ ১৬ হাজার ২২২ কোটি টাকা। প্রকল্প সাহায্য হরাস পাওয়ায় বার্ষিক উন্নয়নকর্মসূচি বরাদ্দ কিছুটা হরাস পেয়ে ৬০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। সবমিলিয়ে সংশোধিত এডিপি’র আকার দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪অর্থবছরের মূল বাজেটে সার্বিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১ লাখ ৬৭হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা যা সংশোধিত বাজেটে ১০ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা হরাস করে১ লাখ ৫৬ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা ধার্য করা হয়েছে। অন্যদিকে মূল বাজেটেপ্রাক্কলিত ঘাটতি ধরা হয়েছিলো জিডিপি’র ৪.৬ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে তাসামান্য বৃদ্ধি পেয়ে ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ ঘাটতির মধ্যে বৈদেশিক উত্স থেকেজিডিপি’র ১.৬ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে জিডিপি’র ২.৫ শতাংশেরসংস্থান করা হবে।
উপসংহার: অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় আশাবাদব্যক্ত করে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক ও আভ্যন্তরীণ বাস্তবতার নিরিখে যে বাজেটকাঠামোটি আগামী অর্থবছরে বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি তা যেমন প্রবৃদ্ধি সহায়কহবে, তেমনি মূল্যস্ফীতিকে সংযত রাখবে। জনগণ এতে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষারপ্রতিফলন দেখবেন।’অর্থমন্ত্রীর এ বক্তৃতা যেন শুধু কথার কথাই না হয়।