চূড়ান্ত রায়েও কামারুজ্জামানের ফাঁসি বহাল : যেকোনো দিন কার্যকর

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ বহাল রেখেছেন। তবে ফাঁসি দেয়ার প্রশ্নে আপিল বিভাগের একজন বিচারক দ্বিমত পোষণ করেছেন। কামারুজ্জামানকে এর আগে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির দণ্ড দিয়েছিলেন। এর বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেন।

গতকাল সোমবার আপিল বিভাগের বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ চূড়ান্ত রায়ে এ ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখেন। এখন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর সরকারের নির্ধারিত যেকোনো দিন কারা কর্তৃপক্ষ কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করতে পারবে। তবে কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে তারা রিভিউ পিটিশন দাখিল করবেন। এদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের রিভিউ পিটিশন দায়ের করার সাংবিধানিক অধিকার নেই।

গত বছরের ৯ মে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ৬ জুন আপিল করেন কামারুজ্জামান। চলতি বছরের জুন মাসে আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়ে শেষ হয় গত ১৭ সেপ্টেম্বর। প্রায় দেড় মাস পর গতকাল সকাল ৯টা ১০ মিনিটে আপিলের রায় ঘোষণা করা হয়। রায় ঘোষণাকালে আপিল বিভাগের এক নম্বর আদালতকক্ষ ছিলো জনাকীর্ণ। আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট নাগরিকরা উপস্থিত ছিলেন আদালত কক্ষে। সকাল ৯ টা ১১ মিনিটে বিচারপতি এসকে সিনহা সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা শুরু করেন। তিন মিনিটের মধ্যে রায় পড়া শেষ হয়। ঘোষণায় বলা হয়, আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখা হলো।

আপিল বিভাগের রায়ে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সোহাগপুর হত্যাকাণ্ডে ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায় বহাল রাখা হয়। শুধু বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা এ হত্যায় তাকে অভিযুক্ত করার বিষয়ে অন্য তিন বিচারপতির সাথে একমত পোষণ করলেও ফাঁসির প্রশ্নে তিনি দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন দণ্ডে দণ্ডিত করার অভিমত দেন।

এদিকে গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ ওই দণ্ড কমিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। এছাড়া বদিউজ্জামান ও দারাসহ ছয়জনকে হত্যার দায়ে কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বদিউজ্জামান হত্যার দায় থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দিলেও দারাসহ ৫ জনকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন দণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এ দণ্ড দেয়া হয়।

একাত্তরে শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানের প্রতি অমানবিক আচরণের দায়ে কামারুজ্জামানকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। আপিল আদালত সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এ দণ্ড বহাল রাখেন। তবে গোলাম মোস্তফা, বদিউজ্জামান ও দারাসহ ৫ জনকে হত্যা ও শিক্ষক গোলাম মোস্তফাকে নির্যাতনের দায়ে ট্রাইব্যুনাল যে দণ্ড দিয়েছিলেন তা বাতিল করে কামারুজ্জামানকে খালাস দিয়েছেন বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা।

প্রমাণিত চার অভিযোগ: একাত্তরের ২৫ জুলাই সকালে আলবদর ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় ও নারীদের ধর্ষণ করে। ওই হত্যাযজ্ঞের পর থেকে গ্রামটি বিধবা পল্লি নামে পরিচিতি পায়।

একাত্তরে কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুকপেটা করে। একাত্তরের ২৩ আগস্ট কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা শেরপুর শহরের কলেজ মোড় এলাকা থেকে গোলাম মোস্তফাকে ধরে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে স্থাপিত আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। গোলাম মোস্তফার চাচা তোফায়েল আহমেদ সেখানে কামারুজ্জামানের কাছে গিয়ে (গোলাম মোস্তফা) ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু রাতে কামারুজ্জামান ও আলবদর সদস্যরা গোলাম মোস্তফা ও আবুল কাসেম নামের একজনকে সেরিহ সেতুর কাছে নিয়ে গুলি করে। গোলাম মোস্তফা নিহত হন এবং আঙুলে গুলিবিদ্ধ কাসেম নদীতে লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচে যান। মুক্তিযুদ্ধকালে ২৭ রমজান বেলা একটার দিকে কামারুজ্জামান ১৫-২০ জন আলবদর সদস্যকে নিয়ে ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানার কাঁচিঝুলি গ্রামের গোলাপজান রোডে ট্যাপা মিয়ার বাড়িতে হামলা চালায়। ট্যাপা ও তার বড় ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে অবস্থিত আলবদর ক্যাম্পে নেয়া হয়। পরদিন সকালে আলবদররা তাদের আরও পাঁচজনের সাথে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে নিয়ে সারিতে দাঁড় করায়। প্রথমে ট্যাপাকে বেয়নট দিয়ে খোঁচাতে গেলে তিনি নদীতে লাফিয়ে পড়েন। আলবদররা গুলি করলে তার পায়ে লাগে, তবে তিনি পালাতে সক্ষম হন। অন্য ছয়জনকে বেয়নট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।