চুয়াডাঙ্গা সরকারি শিশু পরিবারে আশ্রিতরা আদর সোহাগের বদলে দিন কাটায় ছাগল পালনের কষ্টে

 

স্টাফ রিপোর্টার: শিশু পরিবারে আশ্রিতদের তথা এতিমদের স্নেহে ভালোবাসা ও আদরযত্নে বড় করে তোলার কথা থাকলেও চুয়াডাঙ্গার চিত্রটা ভিন্ন। এতিম শিশুদেরই যত্ন করতে হয় ছাগল, হাঁস-মুরগির। কর্তাদের কাপড় কাচা তো প্রশিক্ষণের অংশ বলেই চালানো হয়। আর খাবার? গতকাল দুপুরে ভুড়ি আলুর তরকারি বলে চালানো তরকারিতে ভুড়ির মৃদু গন্ধ থাকলেও তার তেমন অস্তিত্বই ছিলো না। এ বিষয়ে শিশুদের নিকট জানতে চাওয়া হলে তারা অজানা ভয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুঝিয়ে দেয়, তারা সত্যিই বড় অসহায়।

জানা গেছে, যারা পিতৃ-মাতৃহীন বা পিতৃহীন দরিদ্র শিশু তাদেরই আশ্রয়স্থল সরকারি শিশু পরিবার। প্রতিষ্ঠানটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণাধীন সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। উদ্দেশ্য, এতিম শিশুদের ভরণপোষণ, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং উপযুক্ত মর্যাদায় সমাজে পুনর্বাসন করা। চুয়াডাঙ্গা শিশু পরিবারের এক সময় নাম ছিলো এতিমখানা। ওই প্রতিষ্ঠানে ৫-৯ বছর থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত এতিম শিশুদের প্রতিপালন, পারিবারিক পরিবেশে স্নেহ-ভালোবাসা ও আদরযত্নের সাথে লালন পালনের কথা। ওদের শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান, নিবাসীদের শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক উৎকর্ষতা সাধনের পাশাপাশি পুনর্বাসন ও স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাসহ নানা সেবামূলক কর্মকাণ্ড সাধনের কথা। অথচ চুয়াডাঙ্গা সরকারি শিশু পরিবারে (বালিকা) তার চিত্র ব্যতিক্রম। এ মর্মে অভিযোগ পাওয়ার পর গতকাল সরেজমিন গেলে পাওয়া যায় কষ্টের নানা চিত্র। উঠে আসে চুয়াডাঙ্গা সরকারি শিশু পরিবারের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক ইলিয়াসের বিরুদ্ধে উত্থাপিত নানা অনিয়মের চিত্র। সহকারী তত্ত্বাবধায়ক ইলিয়াস হোসেনের বিরুদ্ধে শিশুদের দিয়ে হাঁস-মুরগি ও ছাগল পরিচর্যা করিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। সরেজমিনে গিয়ে এর সত্যতা মিলেছে। এবার কোরবানিতে তিনি প্রায় দেড় লাখ টাকার ছাগল বিক্রি করেছেন বলেও একাধিকসূত্র জানিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, চুয়াডাঙ্গা শিশু পরিবারে সহকারী তত্ত্বাবধায়ক যেভাবে এতিম শিশুদের রেখেছেন তা ভাষায় বর্ণনা করা সত্যিই কঠিন। অবাক হলেও সত্য যে, সহকারী তত্ত্বাবধায়কের ছাগল শিশুদের থাকার খাটও ব্যবহার করে। পুকুরে মাছচাষ, তামাম উঠোন জুড়েই হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা। ছাগলের নাদিতেই যেন সাক্ষ্য দিচ্ছে এতিম শিশুদের ওপর কতোটা ছাগল পালনের দায়িত্ব।

ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালনসহ শাড়ি কাপড় ধুয়ে নেয়ার অভিযোগের পাশাপাশি পাওয়া গেছে খাবার পরিবেশনে অনিয়মের চিত্র। শিশুদের দিয়ে রান্না ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করানোর দৃশ্যটি যতোটা না স্পর্শকাতর, তার চেয়ে বেশি তাদের ভাতের সাথে দেয়া তরকারি। ছোট শিশুদের দিয়ে নারকেল পাতার খিলান তৈরি করা, তরকারি কোটা, নারকেল কাটাসহ বিভিন্ন ধরনের ভারি কাজ যেমন করানোর দৃশ্য যেমন সাংবাদিকদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, তেমনই সহকারী তত্ত্বাবধায়ককে দেখে তাদের ভীত সন্ত্রস্থতার বিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। নির্যাতনের দৃশ্য দেখে দু চোখের জল আর বাঁধ মানেনি এ প্রতিবেদকেরও। যেখানে দেশে প্রচলিত আইনে শিশু নির্যাতন বন্ধের কথা বলা হয়েছে, সেখানে কিন্তু ওই আইনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সহকারী তত্ত্বাবধায়ক ইলিয়াছ হোসেন তাদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করাচ্ছেন।

শিশু পরিবারের এমন সব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই উপতত্ত্বাবধায়ক আবু নাসির জানান, তিনি শিশু পরিবারে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। শিশু পরিবার মোট ৯০ জন শিশু ভর্তি রয়েছে। শিশুদের দিয়ে কোনো ভারী কাজ বা ছাগল পালন করানো করাই না। ওইসব ছাগল ইলিয়াছ সাহেবের। তাকে গত ১৫ জুন সরকারি শিশু পরিবারের অভ্যন্তরে গবাদি পশুপাখি পালন না করার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত ইলিয়াছ হোসেন বলেন, আমি কোনো চিঠি পাইনি। তাছাড়া এখানে মোট ১২টি ছাগল আছে। এর মধ্যে ২টি শিশু পরিবারে দান করা, ১টি অফিস সহায়ক কালামের ও বাকিগুলো আমার। এর মধ্যে ১টি খাসি ছাগল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আগামী ১৬ অক্টোবর খাওয়ানো হবে। পরে নিউজটি বন্ধ করতে ঘুষ প্রদানের প্রস্তাব দেন তিনি।

এদিকে স্থানীয় সচেতনমহল বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে ওই কর্মকর্তার শাস্তির দাবিতে জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এতিম শিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাদের ওপর এমন নির্মম অত্যাচার বন্ধ হওয়া উচিত। ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে’ বিদ্রোহী কবি নজরুলের কবিতার লাইনটির মতো আজকের শিশুদের রক্ষায় আমাদেরই জাগতে হবে। পরির্দশনে গিয়ে শিশুদের কষ্টে পালন করা খাসি খাওয়ার মানসিকতাও বাদ দিতে হবে পদস্থ কর্তাদের।