চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে রোগীর ১৩ হাজার টাকাসহ সোনার দুল চুরি

চিকিৎসার জন্য কর্জ করা টাকা এবং আর্তনাদ

 

স্টাফ রিপোর্টার: হাসপাতালে হঠাত চিৎকারে কেঁদে ওঠা, স্বজন হারানো আর্তনাদ নতুন কিছু নয়। কিন্তু টাকা হারিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে, বুক চাপড়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়া? পূর্বে তেমন না ঘটলেও এখন মাঝে মাঝেই ঘটে। ঘটবে না? হাসপাতালের প্রায় সব ওয়ার্ডেই যে চোর ঘুর ঘুর করে!

গতকাল সোমবার বিকেলে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের মহিলা সার্জিকেল ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগী জাহানারা খাতুনের শয্যার বালিশের নিচ থেকে ১৩ হাজার টাকাসহ সোনার এক জোড়া দুল হারিয়ে যায়। টাকাগুলো দরিদ্র জাহানারা খাতুনের চিকিৎসার জন্য তারই মেয়ে পারুলা স্বামীর মাধ্যমে ধার করে এনেছে। চিকিৎসার জন্য ধার করে আনা টাকা চোখের পলকে চুরি হলে মাথা কি ঠিক থাকে? দিশেহারা হয়ে পড়েন পারুলা খাতুন (২৫) ও তার অসুস্থ মা জাহানারা খাতুন (৫৪)।

কী হয়েছে জাহানারা খাতুনের? কেনই বা লাগবে অতো টাকা? এসব প্রশ্নের জবাব জানতে গিয়ে পাওয়া গেছে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের সার্জিকেল ওয়ার্ডের অনিয়মের খানেক চিত্র। দালালদের উৎপাতও আছে এর আড়ালে। পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার চিকিৎসার জন্যই মূলত চুয়াডাঙ্গা ফার্মপাড়ার দরিদ্র সেকেন্দার আলীর স্ত্রী জাহানারা খাতুন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সেকেন্দার আলী কখনো আইসক্রিম ফেরিওয়ালা, কখনো ভ্যানচালক। সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় অপারেশনের জন্য দাঁড় করানো হয়েছে অনেক অজুহাত। বলা হয়েছে, অপেক্ষা করতে হবে কমপক্ষে ২০ সপ্তাহ। আর দালাল বলেছে, হাসপাতাল ছেড়ে ক্লিনিকে গেলে দু-একদিনের মধ্যেই অপারেশন হবে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে লাগবে খুব জোর ৫ দিন। ঝণ্টুর ক্লিনিকে হাসপাতালের সার্জিকেল কনসালটেন্টই অপারেশন করবেন। ক্লিনিকে নিয়ে অপারেশন করাতে খরচ হবে ৭ হাজার টাকা। আর ওষুধ পথ্যের জন্য বাকি টাকা জোগাড় করা। তাও হাসপাতালের বিছানা থেকেই গতকাল চুরি হয়ে গেছে। এখন কী হবে?

কে জানে জাহানারা খাতুনের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে? পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার কারণে বেশ কিছুদিন ধরে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। কয়েক দফা তাকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করানো হয়। পিত্তথলির পাথর অপসারণে অস্ত্রোপচার করতে হবে। চিকিৎসক এ কথা বলে কয়েক সপ্তার ওষুধ লিখে দেন। সেই ওষুধে মাঝে মাঝে যন্ত্রণা কমে, মাঝে মাঝে যন্ত্রণা তীব্রতর হয়। ফলে গতপরশু জাহানারা খাতুনকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল ভর্তি করিয়ে অপারেশনের জন্য তদবির শুরু করেন। কিন্তু সার্জিকেল কনসালটেন্ট জানিয়ে দেন, কয়েক সপ্তার আগে হাসপাতালে ওই রোগীর অপারেশন করা যাবে না। ইনফেকশনসহ নানা সমস্যা আছে। কিন্তু জাহানারা খাতুনের যন্ত্রণা তো যায় না। কী করা যায়? খোঁজখবর নিতেই জাহানারা খাতুনের মেয়েরা জানতে পারেন, টাকা দিলে ক্লিনিকে ওই চিকিৎসকই অপারেশন করবেন। মা দ্রুত সুস্থও হবেন। যন্ত্রণা থাকবে না। হাসপাতালেই ঘুর ঘুর করা এক দালালের মাধ্যমে জানার পর জাহানারা খাতুনের এক মেয়ে পারুলা খাতুন তার মায়ের সুস্থতার জন্য টাকা জোগাড়ে মরিয়া হয়ে ওঠেন। তিনি জীবননগর তেঁতুলতলার ট্রাকচালক রাশেদুলের স্ত্রী। স্বামীকে মায়ের যন্ত্রণার কথা জানান। স্বামী তার ট্রাকমালিক আরিফের নিকট থেকে ১০ হাজার টাকা ধার করে স্ত্রী পারুলা খাতুনের হাতে তুলে দেন। পারুলা ওই টাকা আর মায়ের গচ্ছিত ৩ হাজার মোট ১৩ হাজার টাকা হাসপাতালের বিছানার বালিশের নিচে রাখেন। তার মা বিছানায় তখনও শুয়ে। পারুলা পানি নিতে বাইরে গেছেন। ঘুরে কিছুক্ষণ পর বালিশের নিচে হাত দিয়ে দেখেন টাকা নেই, নেই সোনার এক জোড়া দুলও। টাকা না পেয়ে পারুলা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার অসুস্থ মা জাহানারা খাতুনও বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকেন। ভিড় জমে যায়।

অল্প সময়ের মধ্যে কে এমন এসেছিলো যে, চুরি হলো? জবাব মেলেনি। পাশেই ফ্লোরে চিকিৎসাধীন ছিলেন নাগদহের মধুপুরের এক রোগী। ওই রোগী গতকালই ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। ওর ছুটির পর টাকার হাদিস করতে গিয়ে না পেয়ে সন্দেহের তীর তার দিকেই পড়ে। অবশ্য গতকাল এলাকার জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে মধুপুরে ওই রোগী সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত টাকার হদিস মেলেনি। পারুলা ও তার অসুস্থ মায়ের কান্না থামেনি। কপাল থেকে যায়নি দুশ্চিন্তার ভাজ। ওই ভাজ দূর করবে কে? পুলিশ, চিকিৎসক নাকি ক্লিনিক কর্তা? দায় এড়ানো সমাজে এসব প্রশ্নের জবাব কি মেলে?