চুয়াডাঙ্গা বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা যতোটা নড়বড়ে আওয়ামী লীগের অতোটা না হলেও লাগছে বাতাস এমপি হওয়ার স্বপ্ন

মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা যতো বাড়ছে ততোই চড়ছে কিছু নেতা-কর্মীর দর

 

স্টাফ রিপোর্টার: এমপি হওয়ার স্বপ্নে চুয়াডাঙ্গায় বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনই আওয়ামী লীগেও। মনোনয়নকে কেন্দ্র করেই একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছে নেতা-কর্মীরা। ফলে উভয়দলেরই সমর্থকদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা।

মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনই কোনো কোনো নেতার দক্ষিণাও হচ্ছে চড়া। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে যারা মৌসুমী তাদের অধিকাংশেরই কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে গণসংযোগ ও পথসভায় লোকজড়ো করতে হচ্ছে বলে পোড়খাওয়া বা দলের দুর্দিনে নাকানি চুবানি খাওয়া নেতার অনুসারীদের অভিযোগ। মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা বেড়েছে বলেই পেশাধারী রাজনৈতিক নেতাদের কারো কারো পকেট ভারী হয়েছে বলেও অভিমত অনেকের। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের কারো কারো অভিমত, রাজনৈতিক আদর্শের বদলে কারো কারো কাছে প্রধান্য পাচ্ছে মনোনয়ন প্রত্যাশী বাড়ানোর বাণিজ্য।

চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সভাপতি হাজি মো. মোজাম্মেল হক। তিনি চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে পর পর দু বার নির্বাচিত হন। সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি অবশ্য মনোনীত বঞ্চিত ছিলেন। আসন্ন নির্বাচনে তিনি একই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের একজন। অবশ্য কারো কারো দৃষ্টিতে বয়স যদি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা হলে তার ছোট ছেলে মিথুন আসতে পারেন এ তালিকায়। যদিও তৃণমূল পর্যায়ে তার তেমন উপস্থিতির অভাব বলেই অভিমত দলীয় অনেকের। চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান দুদু। তিনি চুয়াডাঙ্গা-১ আসন থেকে ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হলেও ছিলেন বিরোধীদলীয় এমপি। কেন্দ্রীয় নেতা হয়েও আন্দোলন সংগ্রামে সে সময়ের অনুপস্থিতি তাকে পিছিয়ে দেয়। ২০০১ সালে মনোনয়ন বঞ্চিত হন। কেন্দ্রীয় ভাবমূর্তি ফিরিয়ে বেশ চাঙ্গা অবস্থানেই তিনি। চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে নির্বাচিত হওয়ার সময় স্থানীয় রাজনীতিতে তেমন দখল ছিলো না। মিঞা মো. মনুসুরকে সরাতেই মূলত তাকে স্থানীয় রাজনীতিতে আনেন তৎকালীন পোড়খাওয়া নেতা। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সহিদুল ইসলাম বিশ্বাস। জেলা বিএনপির সভাপতি হাজি মো. মোজাম্মেল হকেরও সমর্থন ছিলো। ২০০১ সালে মনোনয়ন বঞ্চিত হলেও শামসুজ্জামান স্থানীয় রাজনীতিতে তেমন দৃষ্টি দেননি। কারণ ওই সময় চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সহিদুল ইসলাম বিশ্বাস। নির্বাচিত হওয়ার কয়েক বছরের মাথায় অসুস্থ হলেন। মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ। নেতৃত্বে চরম শূন্যতা ফুটে উঠলো। সহিদুল ইসলাম বিশ্বাসের সহোদর সাবেক পৌর চেয়ারম্যান অহিদুল ইসলাম বিশ্বাস হাল ধরতে চাইলেও মোজাম্মেল হকসহ অনেকের সাথেই বৈরী সম্পর্ক রাজনীতির পথকে করে তুললো রুদ্ধ। এরপরও তিনি গত নির্বাচনে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে মনোনীত হলেন। পরাজয়ের কারণে অবস্থান যেমন নড়বড়ে হলো, তেমনই অনেকেই তার পক্ষ ত্যাগ করে শামসুজ্জামান দুদুর সাথে হাত মেলালেন। স্থানীয় রাজনীতিতে জোরালো ভূমিকা রাখতে শুরু করলেন দুদু। কমিটি গঠন হলো। মোজাম্মেল হক সভাপতি হলেন, শামসুজ্জামান দুদু বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হয়েও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদটি নেয়ার মধ্য দিয়ে আসন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি অনেকটাই চূড়ান্ত করে তুললেন। অপরদিকে অহিদুল ইসলাম বিশ্বাস সভাপতি হয়ে এক সময়ের দুদুর সাথে থাকা খন্দকার আব্দুল জব্বার সোনাকে সাধারণ সম্পাদক করে পাল্টা কমিটি গঠন করলেন। খন্দকার সোনা অবশ্য সে পক্ষ ত্যাগ করলেও দুদুপক্ষে এখন পর্যন্ত হাত মেলাননি। চুয়াডাঙ্গা বিএনপির দু পক্ষ পৃথক পৃথকভাবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীসহ কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালন করে আসছে। এর মাঝে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ভিড়ে আরো কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন লে.কর্নেল (অব.) কামরুজ্জামান, জেলা বিএনপির অর্থ বিষয়ক সম্পাদক চুয়াডাঙ্গার ছেলে ঢাকার ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম। এ ছাড়া আলমডাঙ্গা উপজেলা বিএনপির সভাপতি শহিদুল কাওনাইন টিলু যেমন মনোনয়ন পেতে আবেদন করবেন বলে তার নিকটজনেরা জানিয়েছেন, তেমনই আলমডাঙ্গা পৌর মেয়র বিএনপি নেতা মীর মহিউদ্দীন। টিলু জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দুদুর পক্ষেই আছেন এবং মীর মহিউদ্দীন বর্তমানে পক্ষমুক্ত বলেই দাবি করেন। তিনি অবশ্য এক সময় অহিদুল ইসলাম পক্ষেই ছিলেন। এ ছাড়া কিছুদিন আগে নাসির উদ্দীন নামের একজন তার এলাকায় এসে কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সে কার্যক্রম অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, তিনি ঢাকায় ফিরে নিজের ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত রয়েছেন বলে শোনা যায়। এ ছাড়া গত নির্বাচনে এ আসনে ড. আসাদুজ্জামান মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় থাকলেও জিয়া ফাউন্ডেশনের এ নেতার তেমন নড়নচড়ন এলাকায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তিনি এলাকার ধান্দাবাজ বা দক্ষিণা নেয়া নেতাদের উৎপাতেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন বলে তার এক সময়ের ঘনিষ্ঠ অনুসারীরা জানিয়েছেন।

চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে যুবদলের কেন্দ্রীয় শিল্প বিষয়ক সম্পাদক তরুণ শিল্পপতি আন্দুলবাড়িয়ার সন্তান মাহমুদ হাসান খান বাবু কয়েক বছরে সপক্ষে জোরালো অবস্থান গড়েছেন। সুযোগটা মূলত এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাজি মো. মোজাম্মেল হকের দীর্ঘ অনুপস্থিতিটাই বাবু খানের জন্য সোনায় সোহাগা হয়েছে বলে অভিমত অনেকের। তাকে চুয়াডাঙ্গা-২ নির্বাচনী এলাকার দলীয় হাল ধরার জন্য যারা আহ্বান জানিয়েছিলেন বলে আলোচনায় তাদের মধ্যে জীবননগর উপজেলা বিএনপি নেতা আনোয়ার হোসেন খান অন্যতম। একই আসনের একই দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে পৃথকভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন দর্শনার বাসিন্দা ঢাকার ব্যবসায়ী ইঞ্জিনিয়ার মোখলেসুর রহমান তরফদার টিপু। তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির অহিদুল ইসলাম বিশ্বাস পক্ষের সহসভাপতি। এ আসনে আরো একজন মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন তিনি হলেন টিপু তরফদারেরই ভাতিজা শাওন তরফদার। টিপু তরফদারের আগে শাওন তরফদারই ছিলেন অহিদুল ইসলাম পক্ষে ওই আসনে লাইম লাইটে। দীর্ঘদিন ধরে শাওন তরফদারের অনুপস্থিতি তার চাচার জন্যই সুবিধাজনক হয়েছে বলে ধারণা দর্শনার অনেকের।

চুয়াডাঙ্গা বিএনপির মতো অতোটা না হলেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যাও অল্প হলেও বেড়েছে। চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে আলমডাঙ্গা কেন্দ্রিক একজনের কার্যক্রম কয়েক মাস ধরে জোরালো হলেও চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে নৌকা প্রতীক প্রত্যাশীর সংখ্যা রাতারাতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে হাফ ডজন। এ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক হাজি আলী আজগার টগর। মনোনয়ন যুদ্ধে গতবার তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য সাবেক সংসদ সদস্য মীর্জা সুলতান রাজা। তিনি অসুস্থ। রাজনীতির মাঠে বয়স এখন বড় বাধা। ফলে তার ছোটভাই মির্জা শাহারিয়ার লণ্টু উঠে এসেছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায়। মাঝে মাঝে তিনি এলাকায় গণসংযোগ করেন। গতবারের অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজাদুল ইসলাম আজাদ অবশ্য পরবর্তীতে দামুড়হুদা উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আসন্ন নির্বাচনেও মনোনয়ন চাইবেন বলে তার ঘনিষ্টজনদের অভিমত। এছাড়া মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় অল্প কিছুদিনের মধ্যে উঠে এসেছেন অ্যাড. আলমগীর হোসেন পিপি। তাকে আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ মনোনীত করেছে। দলীয় মনোনয়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছেন। তরুণ নেতা শাহরিয়ার কবিরও মনোনয়ন প্রত্যাশীদের একজন বলে সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। তিনি অবশ্য ঢাকার জজ কোটে আইন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।

চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান সংসদ সদস্য সোলায়মান হক ছেলুন থাকলেও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আলমডাঙ্গার ছেলে শামসুল আবেদীন খোকন কার্যক্রম জোরদার করেছেন। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে এ আসনে সাংগঠনিক জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। আলমডাঙ্গার বেশ কয়েকজন নেতা যেমন তার পক্ষে, তেমনই জেলা ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজন নেতা তার সাথে হাত মিলিয়েছেন। সর্বশেষ বৈঠকে নেতাদের মধ্যে বিভক্তির চিত্র ফুটে ওঠে। শামসুল আবেদীনের সভা ছিলো আলমডাঙ্গা, আর সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন এমপির মতবিনিময়সভা অনুষ্ঠিত হয় চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা মিলনায়তনে।

‌                জেলা বিএনপি সাংগঠনিকভাবেই বিভক্ত। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের গ্রুপিং লবিঙে বহুভাগে বিভক্ত নেতা-কর্মীরা এখন পৃথক পৃথক কর্মসূচিতে অংশ নেন। ফলে সাংগঠনিক ভিত ও নেতৃত্বে চেইন অব কমান্ড দুর্বল। মূলত সে কারণেই সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস। কেন্দ্রীয়ভাবে চুয়াডাঙ্গা বিএনপির বিরোধ নিষ্পত্তির যেমন উদ্যোগ নেয়নি, তেমনই মনোনয়ন প্রত্যাশীদের এক কাতারে সামিল হওয়ারও তেমন তাগিদ নেই। অবশ্য চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে অতোটা নয়, যতোটা নড়বড়ে অবস্থায় বিএনপি। আওয়ামী লীগেরও অভিন্ন দশা হতে পারে যদি কেন্দ্রীয় শক্ত হস্তক্ষেপ না থাকে। বিএনপির বিভক্তির বাতাস আওয়ামী লীগের দিকেও ঝুঁকেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল এখন এরকমই মন্তব্য করছেন।