চুয়াডাঙ্গা থেকে ট্রাকযোগে ঢাকায় গরু নিতে ৮টি পয়েন্টে দিতে হচ্ছে চাঁদা

 

টাকা না দিলে নানা অজুহাতে হয়রানির হুমকিধামকি : অতিষ্ঠ চালকব্যপারী

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা থেকে এক ট্রাক গরু নিয়ে গতকাল বুধবার সকালে গাবতলী পশুহাটে পৌঁছান চুয়াডাঙ্গার ব্যাপারী আলমাস উদ্দিন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, রাস্তায় দফায় দফায় পুলিশের টাকা আদায়। চাঁদা আদায়ের কারণে, মাঝারি আকারের ১৬টি গরু চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকায় নিতে ট্রাক ভাড়ার বাইরে তাকে ৮টি পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয়েছে ১ হাজার ৯০০ টাকা। এ টাকা নিয়েছে থানা পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, এলাকার মাস্তান ও আরিচা এবং দৌলতদিয়া ঘাটের মস্তানরা। ট্রাকচালক বশির মিয়ার অভিযোগ, সাভার ও ধামরাইয়ে ২০০, মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে ১৫০, আরিচা ঘাটে ২০০, দৌলতদিয়া ঘাটে ৫০০, ফরিদপুরে ১৫০, মাগুরায় বাসস্ট্যান্ডের কাছে ১৫০, ঝিনাইদহে ১৫০, চুয়াডাঙ্গায় ২০০ ও আলমডাঙ্গায় ২০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। গরুর ট্রাক দেখলেই গাড়ি থামানোর জন্য বলা হয়। আর কাগজপত্র তল্লাশি, রেকারিঙয়ের হুমকি, ফেনসিডিল-ইয়াবা আছে বলে গরু নামিয়ে তল্লাশির নামে অহেতুক হয়রানি করার চেষ্টা করে পুলিশ অথবা সড়কপথের বিভিন্ন এলাকার মস্তানরা। কিন্তু চাঁদা দেয়ার সাথে সাথেই পথ ছেড়ে দেয় তারা। তাই ট্রাকের প্রকৃত ভাড়ার সাথে প্রতি ট্রিপে অতিরিক্ত দু হাজার টাকা (চাঁদা) যোগ করেই এখন ভাড়া নির্ধারণ করা হচ্ছে বলে জানান ট্রাকচালক। ব্যাপারীরা জানান, এবার ভারতের গরু আসছে খুবই সামান্য। সীমান্তে বিএসএফের ব্যাপক কড়াকড়ির কারণে আগের মতো বিপুল সংখ্যক গরু আসার বিষয়টি অনিশ্চিত। তাই এবার কোরবানির পশুর দাম চড়া হওয়ার আশঙ্কা আছে। তার ওপর বেপরোয়া চাঁদাবাজি ঠেকাতে না পারলে গরুর দাম আকাশছোঁয়া বলে মনে করছেন ব্যাপারীরা।

ভারত থেকে গরু কম আসা ও সড়কপথে বেপরোয়া চাঁদাবাজির কথা জানিয়েছেন আমাদের জেলা-উপজেলা প্রতিনিধিরা। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদাবাজির খবর পাওয়া গেছে। আবার চাঁদাবাজি না থাকার খবর পাওয়া গেছে নাটোর ও সিরাজগঞ্জ থেকে। যদিও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা আশা করছেন, এবার গবাদি পশুবাহী গাড়িতে কোনো ধরনের চাঁদাবাজি হবে না। রাজধানীর অস্থায়ী হাটগুলোতে আগামী শনিবারের আগে পশু তোলা যাবে না বলে নির্দেশ দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। এখন রাজধানীর একমাত্র স্থায়ী হাট গাবতলীতে পশু বিক্রি হচ্ছে। এখানকার অধিকাংশ ক্রেতারা ঢাকার বাইরে থেকে আসা। তারা ব্যাপারীদের কাছ থেকে গরু কিনে ট্রাক বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছেন। আসা-যাওয়ার পথে ট্রাকগুলো চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে। গাবতলী হাটে ঝিনাইদহের শৈলকুপার গরু ব্যাপারী শওকত আলীর অভিযোগ, গরুর ট্রাকে সর্বাধিক চাঁদাবাজি হয় দৌলতদিয়া ঘাটে। সেখানে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দাবিদার নূরু মণ্ডল, তার ভাই যুবলীগ নেতা নজরুল মণ্ডল ঘাটের ইজারায় নির্ধারিত টাকার অতিরিক্ত আরও ৫-৬শ টাকা চাঁদা নেন। দৌলতদিয়ার অপর এক ব্যবসায়ী জানান, নজরুল মণ্ডল কোনো কাজ করেন না, তারপরও তিনি কোটি টাকার মালিক। বাড়তি টাকা আদায়ের জন্য তারা নানা কৌশল অবলম্বন করেন। থানা পুলিশও তাদের হাতের মোয়া। তবে নূরু মণ্ডল এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তারা ঘাটে সরকার অনুমোদিত ফি আদায় করেন। ঘাটে কোনো চাঁদাবাজি নেই। ঘাট ইজাদার সূত্রে জানা গেছে, দৌলতদিয়া ঘাট দিয়ে দিনে প্রায় দেড়শ গরুবাহী ট্রাক ফেরি পার হচ্ছে। ঈদ ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে কোরবানির গরুবাহী ট্রাকের সংখ্যাও বাড়ছে।

এদিকে টাঙ্গাইল যমুনা সেতু হয়ে বগুড়া-রংপুর রুটেও গবাদি পশুবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি হচ্ছে। কুড়িগ্রাম থেকে গাবতলী হাটে আসা ট্রাকচালক ইউসুফ ও চালকের সহকারী রুবেল জানান, এক ট্রাক গরু আসতে ভাড়া ২৪ হাজার টাকা। এর সাথে চাঁদা আছে আরও ২ হাজার টাকা। বিভিন্ন স্থানে ৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিয়েছেন তারা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শাহ আলম ব্যাপারী জানান, দু থেকে আড়াই হাজার টাকা চাঁদা বাবদ গুনতে হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের বিশ্বরোড মোড়, শিবগঞ্জ, রাজশাহীর সুলতানগঞ্জ, গোদাগাড়ী, চারঘাট, জুলনপুর, খড়খড়ি, রাইপুরসহ অনেক স্থানে চাঁদা দিতে হয়। শিবগঞ্জসহ কমপক্ষে তিনটি স্পটে ট্রাফিক পুলিশকে ২০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি নজরুল ইসলাম বলেন, আইজিপি নির্দেশ দিয়েছেন কোরবানির গরুবাহী ট্রাক সুনিশ্চিত তথ্য ছাড়া থামানো যাবে না। কাগজপত্র তল্লাশির নামে কোনো ট্রাক থামানো যাবে না। পুলিশের সব ইউনিট সেভাবে কাজ করছে। মাঠ পর্যায়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত আছে। আমরা চাঁদাবাজির কোনো অভিযোগ পাইনি। এবার গবাদি পশুবাহী ট্রাকে কোনো ধরনের চাঁদাবাজি হবে না বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এআইজি বলেন, পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। কোনো ব্যক্তির অপরাধের দায় প্রতিষ্ঠান নেবে না। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, ১৯ সেপ্টেম্বরের আগে রাজধানীর কোনো হাটে গবাদি পশুর গাড়ি প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। পশুবাহী গাড়িতে চাঁদাবাজি বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

প্রতি বছরের মতো এবারও রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সড়কপথে গবাদি পশুবাহী ট্রাকে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। সীমান্ত পয়েন্টে গরু প্রবেশ থেকে শুরু করে হাটে তোলা এবং হাট থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার সময় গরুবাহী ট্রাকে চাঁদা আদায় করা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের তক্তিপুর হাটে টোল আদায়ের পাশাপাশি অতিরিক্ত চাঁদা নিচ্ছে হাট মালিক ও তাদের লোকজন। সেখানে গরুপ্রতি ১০০ টাকা করে চাঁদা নেয়ার অভিযোগ করেন ব্যবসায়ীরা। চাঁদা না দেয়ায় এই হাটে গরু-মহিষ ছিনিয়ে নেয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওবাইদুল নামের একজন গরু ব্যাপারী বলেন, সম্প্রতি চাঁদা না পেয়ে একদল সন্ত্রাসী তার ৮টি গরু আটক করে নিয়ে যায়। পরে তিনি ৪ লাখ টাকা দিয়ে গরুগুলো ছাড়িয়ে আনতে বাধ্য হন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাখেরআলী বিটে গরুপ্রতি ২০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করার অভিযোগ করেছেন ব্যাপারী নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, স্থানীয় চেয়ারম্যানের লোকজন প্রভাব খাটিয়ে এ চাঁদা তুলছে। গরুবাহী ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী সড়কের হরিপুরে। রাজশাহীর কাশিয়াডাঙ্গা মোড়ে শ্রমিকরা গরুবাহী ট্রাকে ২০ টাকা করে চাঁদা নিচ্ছে। এছাড়া বালিয়াপুকুর রেলগেটসহ আরও দুটি স্থানে গরুবাহী ট্রাকে চাঁদা আদায় করা হয় বলে অভিযোগ গরু ব্যাপারীদের। সড়কে গবাদি পশুবাহী ট্রাকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে রাজশাহীর পুলিশ সুপার নিসারুল আরিফ বলেন, রাজশাহী জেলা এলাকায় কোথাও কোনো ধরনের চাঁদা আদায়ের খবর আমরা পাইনি। রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, সড়কে কোথাও চাঁদাবাজির খবর নেই। গবাদি পশুবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশ সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। এরপরও কোনো চাঁদাবাজির প্রমাণ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।