চুয়াডাঙ্গায় স্ত্রীকে শ্বাসরোধে হত্যার অভিযোগ : পুলিশ কনস্টেবল সুমন গ্রেফতার : শ্বশুর ও ননদ-নোন্দাইয়ের গাঢাকা

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় নির্যাতনের পর পুলিশ কনস্টেবলের স্ত্রী ফাতেমা নাসরিন সীমাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। স্ত্রীর কাছে টাকা চেয়ে না পেয়ে স্বামী পুলিশ কনস্টেবল সুমন তাকে হত্যা করেছে বলে সীমার নিকটজনরা জানান। হত্যার অভিযোগে পুলিশ কনস্টেবল সুমনকে আটক করেছে পুলিশ। অন্য অভিযুক্তরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। এ ব্যাপারে সীমার পিতা বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা বাসটার্মিনাল পাড়ার অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক ফজলুল হকের ছেলে পুলিশ কনস্টেবল (৫৪১) মাজেদুল হক সুমন কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার বাধবাজার পুলিশ ক্যাম্পে কর্মরত। পুলিশ জানায়, সুমন ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন। গত শুক্রবার রাত ১২টার দিকে সুমন প্রচার করতে থাকেন তার স্ত্রী সীমা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। প্রতিবেশীরা সীমার লাশ দেখেতে গিয়ে তার গলায় ও পায়ে আঘাতের চিহ্ন দেখে চমকে ওঠে। রাতেই স্ট্রোকে মারা যাওয়ার খবর পেয়ে সীমার আত্মীয় স্বজনরা এলে পুলিশ কনস্টেবল সুমন জানায়, সীমা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। দু রকম কথায় সবার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ভোরে সীমার লাশ ফেলে রেখে স্বামী সুমন, শ্বশুর ফজলুল হক, নোন্দাই আব্দুর রহিম ও ননদ সীমা খাতুন সটকে পড়েন। সকাল ৯টার দিকে সুমনের বাড়ি থেকে সীমার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বেলা ১১টার দিকে এলাকাবাসী পাশের একটি বাড়ি থেকে পুলিশ কনস্টেবল সুমনকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সদর হাসপাতার মর্গে নেয়া হয়। এসআই পিয়ার আলী লাশের সুরোতহাল রিপোর্ট প্রণয়ন করেন। বেলা ২টার দিকে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। নিহত সীমার খালাতো ভাই বাবুল হোসেন জানান, সুমন বরাবরই মাদকাসক্ত। ইতঃপূর্বে কয়েকবার সে বিভিন্ন অভিযোগে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়। সুমন বেশ কয়েকদিন ধরে সীমাকে ২০ হাজার টাকা জোগাড় করে দেয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছিলেন। হয় পিতার কাছ থেকে, না হলে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে দেয়ার জন্য চাপ দেন তিনি। সীমা টাকা দিতে না পারায় তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে সুমন ও তার পরিবারের লোকজন।
গ্রামসূত্রে জানা গেছে, সুমনের পিতা ফজলুল হক ও শঙ্করচন্দ্র ইউনিয়নের জালশুকার শহিদুল ইসলাম ঠাণ্ডু দুজনই সৈনিক ছিলেন। বন্ধুত্বের খাতিরে ২০০৫ সালের ২০ জুন তাদের ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দেন তারা। বিয়ের পর থেকে মাঝে মাঝে টাকার দাবিতে সীমাকে নির্যাতন করতেন সুমন। সীমার বাবা বিভিন্ন সময় তার ৭-৮ বিঘা জমি বিক্রি করে টাকা দিয়েছেন জামাই সুমনকে। বিভিন্ন সময় আরও টাকার দাবিতে সীমাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো। সীমা দু সন্তানের জননী। বড় ছেলে মৃদুল (৯) ৩য় শ্রেণির ছাত্র এবং ছোট ছেলে রাব্বীর বয়স ৩ বছর। সুমন গত ২ মাস থেকে বেতন পাননি বলে সীমার কাছে ২০ হাজার টাকা চান। পিতার কাছ থেকে এনে দিতে চাপ দেন তিনি। বিকল্প হিসেবে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে টাকা দিতে বলেন স্বামী সুমন। গত ১০ ডিসেম্বর ১০ দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসেন সুমন। গত শুক্রবার রাতে শ্বশুর ফজলুল হক, ননদ সীমা ও ছোট ছেলে রাব্বীকে নিয়ে বিজয় মেলায় যায় সীমা। মেলা থেকে ফিরে আসার পর সুমন আবারও টাকার দাবিতে সীমাকে গালাগালি ও নির্মমভাবে শারীরিক নির্যাতন করেন। পরে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে সীমা মারা গেছে বলে প্রচার করেন সুমন। সীমার গলায় ও পায়ে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায় প্রতিবেশীরা। এরপর সুমন কথা ঘুরিয়ে বলতে থাকেন সীমা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। দু রকম কথা বলায় আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে সন্দেহের দানা বাঁধে। ভোর হতে না হতেই ঘরে তালা ঝুলিয়ে সপরিবারে সুমনরা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। পরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও নিহতের পরিবার ও স্থানীয় লোকজনের কাছে ঘটনার বর্ণনা শোনেন চুয়াডাঙ্গা সহকারী পুলিশ সুপার ছুফি উল্লাহ ও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম।
এলাকাবাসী জানায়, প্রায়ই তার স্ত্রী সীমা খাতুনকে টাকার দাবিতে মারধর করতো সে। সীমা দর্জির কাজ করে যা রোজগার করতো তা পুরোটাই সুমনকে দিতে হতো। সুমন বিভিন্ন সময় টাকার দাবিতে নির্মমভাবে তার স্ত্রীকে অত্যাচার করতো। গত শুক্রবার রাতে সীমাকে টাকার জন্য সুমন বেধড়ক মারধর করে।
জালশুকায় গিয়ে জানা যায়, সীমার পিতা শহিদুল ইসলাম ঠাণ্ডু অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক। তিনি বর্তমানে দিনাজপুরে সাউথ ইস্ট ব্যাংকের একটি শাখায় চাকরি করেন। মেয়ে সীমার মৃত্যুর খবর শুনে গতকালই চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছান। তিনি বাদী হয়ে গতরাতে থানায় মামলা করেন। ওসি সাইফুল ইসলাম প্রথমে জানিয়েছিলেন নিরাপত্তার জন্য সুমনকে সেফ দ্য কাস্টডিতে রাখা হয়েছিলো। তবে গতরাতে মামলা দায়েরের পর সুমনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
নিহত সীমার ছোট বোন সুমি খাতুন অভিযোগ করেন, সুমন তার বোন সীমাকে নির্যাতন করে শ্বাসরোধে হত্যা শেষে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজিয়েছে। তার মুখের চারপাশে, গলায় ও পায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। অথচ আমাদেরকে প্রথমে বলা হয়েছে সে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
সুমনের মা জাহিদা খাতুন বলেন, যা হবার হয়ে গেছে। যে চলে গেছে সে আর ফিরবে না। তাছাড়া আমরা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। তিনি বলেন, সীমার সাথে আমাদের পরিবারের কোনো বিবাদ ছিলো না। কী কারণে সে আত্মহত্যা করেছে তা জানি না। তারা যে অভিযোগ করেছে তা মিথ্যা। সুমনের সাথে অভিমান করে ঘরের বাঁশের আড়ায় ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে সীমা।
আমাদের কিছুই হবে না। প্রতিবেশীরা কেউ কেউ জানান, বিধবা ভাবী এক স্কুল শিক্ষিকার সাথে সুমনের অবৈধ সম্পর্ক আছে। এ নিয়েও সীমাকে মাঝে মাঝে সুমন নির্যাতন করতেন।
নিহত সীমা খাতুনের বাবা শহিদুল ইসলাম ঠান্ডু মাথাভাঙ্গাকে জানান, বিয়ের পর থেকেই সুমন যৌতুকের দাবিতে সীমাকে নির্যাতন করতো। সে মাদকাসক্তও ছিলো। তাই বিভিন্ন সময় সে সীমার কাছে টাকা দাবি করতো। ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র দিয়েছি সুমনকে। ৭-৮ বিঘা জমি বিক্রি করে বিভিন্ন সময় মোটা অঙ্কের টাকা দেয়া হয়েছে। তার পরেও সে আরও টাকার দাবিতে আমার মেয়ের ওপর বিভিন্ন সময় অমানবিক নির্যাতন করত। অবশেষে সে সীমাকে মেরে ফেললো। আমি বাদী হয়ে সুমনকে ১ নং, তার বাবা ফজলুল হককে ২নং, তার বোন সীমাকে ৩ নং ও তার দুলাভাই রহিমকে ৪ নং আসামি করে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় মামলা দায়ের করেছি। আমরা ঘাতক সুমনের ফাঁসি চাই।
গতকাল শনিবারই বাদ মাগরিব জালশুকা গ্রামে সীমার দাফন সম্পন্ন হয় বলে গ্রামসূত্রে জানা গেছে।