চুয়াডাঙ্গায় ডায়রিয়া মহামারি আকারে ছড়িয়েছে : হাসপাতালে তিল ধারণের ঠাঁই নেই

 

 

পরিস্থিতি সামাল দিতে চিকিৎসক-সেবিকাদের বাড়তি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকেও তলব

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার কয়েকটি মহল্লায় ডায়রিয়া মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। হাসপাতালে রোগীর চাপে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। আউটডোর থেকে শুরু করে কনফারেন্স রুমেও রোগীর উপচেপড়া ভিড়। ট্রলির সিঁড়িতেও ছিটিয়ে ছড়িয়ে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী পড়ে আছে। পাতলা পায়খানা আর বমিতে বেহাল অবস্থা। পরিস্থিতি সামলাতে সেবিকাদের বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। জেলার অন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে অতিরিক্ত সেবিকা ও চিকিৎসক ডেপুটেশনে নেয়া হয়েছে। গতরাত আড়াইটার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক রোগী মারা গেছেন। তিনি ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন। চিকিৎসক বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে কিডনি ও হৃদরোগে ভুগছিলেন দর্শনা ঈশ্চরচন্দ্রপুরের হাসেম আলী (৪৫)।

রোগীদের শরীরে পুশ করা হচ্ছে কলেরা স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা। সংশ্লিষ্ট এলাকার পানি মহামারি রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে পরীক্ষার জন্য প্রেরণের উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। গতপরশু থেকে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার মসজিদপাড়া, বাগানপাড়া, মাঝেরপাড়া, শেখপাড়া, ইসলামপাড়া, শেখড়াতলাপাড়া ও বড়বাজার এলাকার নারী-পুরুষ শিশু-কিশোর গণহারে ডায়রিয়া আক্রান্ত হতে শুরু করে। পর্যায়ক্রমে হাসপাতালে ভর্তি হন তারা। গতপরশু রাত ৩টা থেকে গতরাত ১১টা পর্যন্ত এসব এলাকার ১শ ৩১ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৯ জন শিশু। গতপরশু ভর্তি ছিলো ৪৭ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী। এতো রোগী রাখবো কোথায়? চিকিৎসাই বা দেয়া হবে কীভাবে? এ নিয়ে ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. পরিতোষ কুমার ঘোষসহ সংশ্লিষ্টদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ডায়রিয়া রোগীদের ভর্তি ফি নেয়া হচ্ছে না। চিকিৎসাও হচ্ছে সস্পূর্ণ নিখরচায়। হাসপাতালে কলেরা সেলাইন, খাবার সেলাইন, আইভি ফ্লুইড, সিপ্রো আইভি ফ্লুডসহ ডায়রিয়া রোগের চিকিৎসার সব ধরনের ওষুধ পর্যাপ্ত রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্টোরকিপার হাদিউজ্জামান হাদি।

গণহারে ডায়রিয়া আক্রান্তের খবর পেয়ে গতকাল হাসপাতাল পরিদর্শন করেন চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সালেহ উদ্দীন আহম্মেদ, সহকারী পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান, সদর থানার ওসি আসাদুজ্জামান মুনসী। সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখেন চুয়াডাঙ্গা বিএমএ সভাপতি ডা. মার্টিন হিরক চৌধুরী। চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন পূর্বের সিভিল সার্র্জনের মতোই সপ্তাহের ছুটিতে অন্যর ওপর চার্জ দিয়ে বাড়িতে যান। ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ডা. পরিতোষ কুমার ঘোষ। তিনি বলেছেন, যে হারে ডায়রিয়া রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তা স্মরণকালের রেকর্ড ভেঙেছে। ১শ শয্যার হাসপাতাল হলেও লোকবল ৫০ শয্যার হাসপাতালের মতোও নেই। এরপর এতো রোগী, সামলাতে গিয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। পরিবেশ পরিষ্কার রাখাও অসম্ভব হয়ে উঠছে। এরপরও রোগীদের সেবা করে সুস্থ করে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। কিছু রোগী কলেরা সেলাইনসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থতা বোধ করলে বাড়ি ফিরছে। বাড়ি ফেরার রোগীর চেয়ে নতুন রোগীর সংখ্যা শনিবার দুপুর পর্যন্ত আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিকেল থেকে অবশ্য চাপ কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে হাসপাতালে কর্তব্যরত সকল সেবিকা ও চিকিৎসকদের বাড়তি দায়িত্ব পালনের অনুরোধ জানানো হয়েছে। সকলেই বাড়তি দায়ত্বি পালন করছেন। হাসপাতালের সিনিয়র সেবিকাদেরও দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে দুজন চিকিৎসক ও দুজন সেবিকা, দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে দুজন সেবিকা জরুরি প্রয়োজনে ডেপুটেশনে নিয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসা প্রদানের কাজে লাগানো হয়েছে। আজ আরো ৪ জন সেবিকাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সদর হাসাপতালে নেয়া হতে পারে।

ডায়রিয়া মহামারিতে রূপ নিচ্ছে কেন? ডায়রিয়া হয় কেন? এসব প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে হাসপাতালের মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা. পরিতোষ কুমার ঘোষ ও ডা. আবুল হোসেন অভিন্ন ভাষায় বলেছেন, ডায়রিয়া পানি ও খাবারবাহিত রোগ। ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া পানি ও খাবারের মাধ্যমে পাকস্থলিতে গেলেই ঘটে বিপত্তি। হাত ঠিক মতো না ধুয়ে খাবার খেলে যেমন ডায়রিয়া হতে পারে তেমনই বাসিপচা খাবারেও ডায়রিয়া হতে পারে। পানীয় পানি অবশ্যই বিশুদ্ধ হতে হবে। পানীয় পানি বিশুদ্ধ না হলে এভাবে ব্যাপকহারে ডায়রিয়া ছড়াতে পারে। সে কারণেই সংশ্লিষ্ট এলাকার পানি মহামারি রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে পরীক্ষার জন্য প্রেরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অপরদিকে ডায়রিয়া আক্রান্ত একাধিক রোগী ও রোগীর লোকজন পৌর সরবরাহকৃত পানির জন্যই ডায়রিয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে বলে অভিযোগ তুলে বলেছেন, কয়েকদিন ধরেই মসজিদপাড়া, বাগানপাড়া, ইসলামপাড়া, মাঝেরপাড়া, শেখপাড়াসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় পৌর সরবরাহকৃত পানি দুর্গন্ধযুক্ত। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার পানি বিভাগের কর্তা আব্দুর রশিদ বলেন, পৌরসভা সরবরাহকৃত পানি নিরাপদ। এরপরও যেহেতু ডায়রিয়া ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেহেতু আমরা ২নং পানি পাম্পটিসহ পানির রিজার্ভ ট্যাঙ্কটি রোববার পরিষ্কার করবো। সংশ্লিষ্ট এলাকার পানির পাইপও চেক করা হবে। পরিষ্কার করে পানি পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রেরণ করা হবে।

চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার কয়েকটি মহল্লায় ডায়রিয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লেও গতকাল হাসপাতালে দেখা যায়নি চুয়াডাঙ্গা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দফতরের প্রকৌশলীকে। সাপ্তাহিক ছুটির কারণে জনস্বাস্থ্য বিভাগ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না তাও জানা সম্ভব হয়নি। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মহাবুব হোসেন মিলন ও ডা. আসাদুজ্জামান মালিক খোকন অভিন্ন ভাষায় বলেছেন, অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। বাসিপচা খাবার পরিহার করতে হবে। খাবার আগে ভালো করে হাত ধুতে হবে। পানি অবশ্যই ফুটিয়ে অথবা বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে বিশুদ্ধ করে পানি পান করতে হবে। ২৪ ঘণ্টায় যে হারে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছেন সে হারে বৃদ্ধি পেলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে উঠবে। ফলে সকলকে বাড়তি সতর্ক হওয়া জরুরি।

গতরাত ১২টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪‌১ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী। পূর্বের দিন হাসপাতালে একই রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন ৪৭ জন। গতকাল ১৪১ জনের মধ্যে শিশু ১৯ জন, মহিলা ৬৯ জন ও পুরুষ ৭২ জন। এদের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা বাগানপাড়ার ২৬ জন, মসজিদপাড়ার ১৩ জন, জিনতলাপড়ার ১১ জন, মাঝেরপাড়ার ১০ জন, শেখরাতলার মোড়পাড়ার ১০ জন, বাজারপাড়ার ৫ জন ও আরামপাড়ার ৫ জন। অন্যরা বিভিন্ন এলাকার। পৌর এলাকার বাইরেরও কিছু রয়েছে।