চুয়াডাঙ্গায় চলতি বছরে শত কোটি টাকার কীটনাশক বিক্রি : দেদারসে ক্ষেতে প্রয়োগ

বিষমুক্ত জিনিস মেলা ভার : বিষযুক্ত সিম বেগুনসহ নানাপদের শবজি খেয়ে বাড়ছে রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা

কামরুজ্জামান বেল্টু/তৌহিদ তুহিন: চুয়াডাঙ্গায় বছরে শত কোটিরও বেশি টাকার কীটনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে শিম, বেগুনসহ বিভিন্ন খাটো আবাদে। চলতি বছরে চুয়াডাঙ্গায় একটি কোম্পানিরই প্রায় ৪২ কোটি টাকার কীটনাশক বিক্রি হয়েছে। কীটপতঙ্গ থেকে শাক শবজি রক্ষার্থে কীটনাশক প্রয়োগের মাত্রা যেমন বাড়ছে, তেমনই বাড়ছে না বুঝে কীটনাশকযুক্ত সবজি খেয়ে কিডনিসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্তের সংখ্যা।
কীটনাশক দেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিম বেগুন ঢেঁড়স বা শাকপাতাড়ি তুলে রান্না করে খেলে কতোটা ক্ষতি তা বুঝে না বুঝেই হাটে বাজারে দেদার বিক্রি হচ্ছে। অথচ কীটনাশক প্রয়োগের ন্যূনতম তিনদিন পর ওই সবজি বা শাক তোলার বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে। কীটনাশক প্রয়োগের ৩দিন পর সবজি বা শাক তোলা হলেও তাতেও থাকে শূন্য দশমিক ৫ পরিমাণের কীটনাশক। এটা মানবদেহের জন্য কিছুটা সহনীয় হলেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা খেলে খানেকটা বিষ খাওয়ার মতোই হয়। খাটো আবাদ করা কৃষকদের অনেকেই পোকামুক্ত সবজি বাজারে ভালো দামে বিক্রির জন্য কীটনাশক প্রয়োগের মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যেই তা তুলে বাজারে বিক্রি করে থাকেন। ভোক্তাদের অনেকেই ওইসব কীটনাশকযুক্ত শাকসবজি রান্না করে খেয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন নানা রোগে। দেদারছে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ এবং কীটনাশক প্রয়োগের ৭২ ঘণ্টা পার হওয়ার আগে তা তুলে খেলে কতোটা ক্ষতি তা কৃষকদের জানানোর মতো ন্যূনতম পদক্ষেপ নেয়ার খবরও মেলে না। খাটো আবাদ করা কৃষকের অধিকাংশেরই অভিমত, কৃষি সম্প্রসাণের উপ-কৃষি কর্মকর্তাদের মাঠে নয়, মাঝে মাঝে গ্রামের কোনো কোনো দোকানের মাচায় বসে জমিয়ে চা খেতে দেখা গেলেও তেমন পরামর্শ মেলে না। ফলে কৃষকরা ওই কীটনাশক বিক্রির দোকানে গিয়ে দোকানির পরামর্শ মতোই কীটনাশক কিনে সকাল-বিকেলে কীটনাশক প্রয়োগ করেন। ভোরে কীটনাশক দিয়ে দুপুরে বেগুন তুলে হাটে নেয়ার ঘটনা এখন হরহামেশাই ঘটে। বাজারে কীটনাশকমুক্ত সবজি পাওয়া ভার। সবই কম বেশি কীটনাশকযুক্ত। প্রতিকারের তেমন উদ্যোগ নেই।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলায় মোট ৭ হাজার ৭শ’ ৫৫ হেক্টর জমিতে খাটো আবাদ হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে শিম, বেগুন, ঢেঁড়স, টমেটো, ধনেপাতা, পেঁয়াজ, রসুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদি। এসব খাটো আবাদের অধিকাংশই কীট থেকে রক্ষা করতে কীটনাশক প্রয়োগ করার প্রবণতা দীর্ঘদিন থেকেই কৃষকদের মাঝে পেয়ে বসেছে। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগের কারণে মাঠে পাখ পাখালিই শুধু হ্রাস পাচ্ছে না, মানুষেরও অকাল মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবাক হলেও সত্য যে, চুয়াডাঙ্গায় মোট ১২০টির মতো কীটনাশক কোম্পানির কীটনাশক বিক্রয় প্রতিনিধি নিযুক্ত রয়েছে। রয়েছে অসংখ্য ডিলার। বিক্রয় প্রতিনিধিরা দোকানিদের কোন আবাদে কোন কীটনাশক দিতে হবে তার কিছুটা ধারণা দেন। তাতেই বিক্রেতারা হয়ে ওঠেন বিশেষজ্ঞ। কৃষকদের অধিকাংশই ওই বিক্রেতাদের পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল। বিক্রেতারা বিক্রি বাড়াতে সকাল-বিকেল আবাদে কীটনাশক প্রয়োগের পরামর্শ দেন। কীটনাশকের গুণগত মান যাচাইয়ের তেমন ব্যবস্থা না থাকার কারণে কৃষকদের অন্ধের মতোই কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। যেদিন বেগুন শিম বা অন্যান্য আবাদ তুলে বাজারে বিক্রি করবেন সেদিন সকালে কিংবা তার আগের দিন বিকেলেও কীটনাশক প্রয়োগ করেন।
চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের মাখালডাঙ্গার রূপা আলী বলেছেন, মাঠে এক বিঘা জমিতে বেগুনের ক্ষেত রয়েছে। মশা মাছি থেকে রক্ষা করতে ক্ষেতজুড়ে জাল দিয়ে ঘেরা। তারপরও প্রতিদিনই সাত সকালে বেগুনে বিষ বা কীটনাশক দিতে হয়। শীতে একদিন বা একদিন পরপর দিলেও চলে। কিন্তু গরমে? তখন সকাল বিকেল না দিলে বেগুন তো পোকার হাত থেকে বাঁচানোই যায় না। কী করবো? উপায় না পেয়ে বিষ দিতেই হয়। আর উপ-কৃষি কর্মকর্তা? ওনাদের তো মাঠে নয়, গ্রামের দোকানের মাচায় মাঝে মাঝে দেখা যায়। সাহেবি ঢঙেই ঘোরেন। কীটনাশক বিক্রির জন্য প্রতিনিধিরা কৃষকদের সাথে ডেকে ডেকে কথা বলেন। কিন্তু উপ-কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের সাথে তেমন কথাই বলেন না। ফলে আমরা জানবো কিভাবে যে, সবজি ক্ষেত থেকে তোলার অন্তত তিনদিন আগে কীটনাশক দিতে হয়?
কীটনাশক প্রয়োগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শবজি তুলে যতোবার ধুয়েই হোক, আর যতো তাপেই রান্না করা হোক না কেন, তাতে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর বিষের মাত্রা থেকেই যায়। ফলে বড় ক্ষতি হয়। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য ভয়ানক ক্ষতির কারণ ওই বিষযুক্ত সবজি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মেডিসিন ও কিডনি বিশেষজ্ঞ ডা. নূরুল ইসলাম চৌধুরী এ মন্তব্য করে বলেছেন, মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগের কারণে কীটনাশকজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এদিকে বিষ কোম্পানি সিনজেন্টা’র চুয়াডাঙ্গায় কর্মরত মার্কেটিং কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ বলেছেন, চলতি বছরে আমাদের কোম্পানির প্রায় ৪২ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকারের কীটনাশক চুয়াডাঙ্গা জেলায় বিক্রি হয়েছে। অটো এগ্রোফেয়ারের চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি আব্দুর রব মিয়া বলেছেন, চলতি বছরে বিক্রির পরিমাণ ৩ কোটি ছাড়িয়েছে। বায়ার এগ্রোর বিক্রি হয়েছে দেড় কোটি, হেকেমেরও বিক্রির পরিমাণ ২ কোটি পার। পপুলাল, স্কয়ার, ইনতেফা, রেভেনসহ শতাধিক কোম্পানির কীটনাশক বিক্রির পরিমাণ কমপক্ষে ১শ’ কোটি বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।