চুয়াডাঙ্গার সড়কে নতুন আতঙ্ক অবৈধ যান : ঘটছে অহরহ দুর্ঘটনা

 স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় চলতি মাসে এ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৫০টি। এর মধ্যে গতকাল রোববারের ঘটনাটিসহ ১২টি ঘটনায় ২৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই আছে অবৈধ যান। নছিমন-করিমন-আলমসাধুর মতো অবৈধ ভটভটির সাথে এখন সড়কে যুক্ত হয়েছে ‘ইটভাটার ট্রলি’ আতঙ্ক। চলতি মাসে এই যান ছয়টি ঘটনায় ছয়জনকে সড়কে পিষে মেরেছে। ইটভাটার ট্রলি ট্রাক্টর বা পাউয়ারটিলার চালিত যান। এই যান দিয়ে সাধারণত ইটভাটার ইট, বালু বা মাটি পরিবহন করা হয়। অথচ ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার দুটিই মাঠে কৃষিকাজের জন্য অনুমোদিত; সড়ক-মহাসড়কে পণ্য বা অন্যান্য সামগ্রী বহনের অনুমতি নেই।

জানতে চাইলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কাজ করা সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) চুয়াডাঙ্গা সভাপতি আলমগীর হোসেন বলেন, কৃষিকাজের জন্য ট্রাক্টর ও পাউয়ার টিলার ব্যবহারের শর্ত থাকলেও এগুলো অবৈধভাবে মহাসড়কে ইট, বালু ও মাটি বহন করছে। মাটি বহনের সময় তা রাস্তায় পড়ছে। সামান্য বৃষ্টিতেই কাদামাটিতে রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি চালক অদক্ষ হওয়ায় এসব যানের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। প্রয়োজনে তারা অবৈধ এসব যানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামবেন।

জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চুয়াডাঙ্গায় বর্তমানে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে শতাধিক ভাটা রয়েছে। ভাটাগুলো মাটি, বালু, ইটসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী বহনে পুরোপুরিই ট্রাক্টর ও পাউয়ারটিলার চালিত ট্রলির ওপর নির্ভরশীল। গড়ে প্রতিটি ভাটায় ২০টি করে এমন যান রয়েছে। সেই হিসাবে জেলার সড়ক-মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ২ হাজারের বেশি ‘ইটভাটার ট্রলি’। চুয়াডাঙ্গায় চলতি মাসে এ পর্যন্ত ইটভাটার ট্রলিতে ছয়টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে তিনটি ঘটনা ঘটেছে ট্রাক্টরচালিত ইটভাটার ট্রলিতে। প্রথম ঘটনাটি ৪ মার্চের। এদিন চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর মহাসড়কে সদর উপজেলার দৌলাতদিয়াড়ে মোটরসাইকেল আরোহী একজন ইউপি সদস্য নিহত হন। একই যানের ধাক্কায় ১০ মার্চ দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গায় এক স্কুলছাত্র ও ১২ মার্চ একই উপজেলার লোকনাথপুরে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। অপর তিনটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে পাউয়ারটিলার চালিত ইটভাটার ট্রলিতে। এর মধ্যে ১৮ মার্চ জীবননগরের উথলীতে স্কুলছাত্রী, ২৪ মার্চ গোয়ালপাড়ায় এক শিশু এবং ২৫ মার্চ দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গায় এক পথচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এই হিসাবে চুয়াডাঙ্গায় চলতি মাসে এ পর্যন্ত ইটভাটার ট্রলিতে প্রাণ গেছে ছয়জনের। কিন্তু সার্বিক হিসাব ধরলে জেলায় চলতি মাসে এ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৫০টি।

বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর বেশির ভাগেরই কারণ অবৈধ যান। অথচ উচ্চ আদালত থেকে চুয়াডাঙ্গাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার মহাসড়কে এসব যান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মঈনুদ্দীন বলেন, সড়কে প্রতিটি দুর্ঘটনার জন্য অবৈধ যানবাহন দায়ী। বৈধভাবে যানবাহন চালাতে গাড়ির নিবন্ধন, বিমা, রুট পারমিট ও ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকা আবশ্যক। অথচ এসব অবৈধ গাড়ি কাগজপত্র ছাড়াই চলছে। চালকদেরও ন্যূনতম প্রশিক্ষণ নেই। এসব কারণে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। চলতি মাসের আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এসব যানের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে প্রশাসনকে অনুরোধ করা হয়েছে। ৩ মার্চ দামুড়হুদার জয়রামপুর কাঁঠালতলায় গরুবাহী লাটাহাম্বার ভেঙে এক যুবক মারা যান। ৫ মার্চ আলমডাঙ্গার বণ্ডবিলে একটি পরিবহনের সাথে ভটভটির সংঘর্ষে এর চালক ও দুই যাত্রী নিহত হন। ১০ মার্চ জীবননগরের সন্তোষপুরে ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী এবং ১২ মার্চ আলমডাঙ্গার শ্রীরামপুরে ভটভটি উল্টে একজন সবজি ব্যবসায়ী মারা যান। এ ছাড়া ২৪ মার্চ জীবননগরের দর্শনা মিলগেটের কাছে মোটরচালিত ভ্যান থেকে পড়ে এক নারী মারা যান। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল রোববার। এদিন দামুড়হুদা উপজেলার জয়রামপুর বটতলায় চুয়াডাঙ্গা-জীবননগর মহাসড়কে বালুভর্তি ট্রাকের সাথে যাত্রীবাহী ভটভটির (আলমসাধু) মুখোমুখি সংঘর্ষে অন্তত ১৩ জন নিহত ও নয়জন আহত হয়েছেন।

চুয়াডাঙ্গায় অবৈধ ভটভটির সংখ্যা কত, সে বিষয়ে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কারও কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে জেলার সড়কগুলোতে এ ধরনের যানের কারণে এখন পা ফেলাই দায়। হাট-বাজারগুলোতে শয়ে-শয়ে এই যান দেখা যায়। সেই হিসেবে জেলাজুড়ে এখন হাজারে হাজারে অবৈধ এই যান দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর সার্কেলের পরিদর্শক এস এম সবুজ বলেন, সড়ক নিরাপত্তার জন্য এসব অবৈধ যানের চলাচল প্রতিরোধ করা জরুরি। এ জন্য শিগগিরই প্রশাসনের সহযোগিতা চাইবেন তারা।

জেলা প্রশাসক সায়মা ইউনুস বলেন, অবৈধ যানবাহনের কারণে জেলায় দুর্ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। এর বিরুদ্ধে শিগগিরই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে জেলা প্রশাসন। এরই মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটদের এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।