চুয়াডাঙ্গার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের হাতে মোবাইলফোন ॥ ব্যাহত হচ্ছে লেখাপড়া

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: দেশের অন্যান্য স্থানের মতো আলমডাঙ্গাসহ জেলার সর্বত্র স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের হাতে এখন স্মার্ট মোবাইলফোন। ফলে একদিকে যেমন ব্যাহত হচ্ছে লেখাপড়া, অন্যদিকে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আসক্ত হচ্ছে পর্নোগ্রাফিতে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সীদের মোবাইলফোন ব্যবহারের নিয়ম নেই। অথচ বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করেই উৎসাহী কিছু শিশু-কিশোর ব্যবহার করছে আধুনিক প্রযুক্তির সব মোবাইলফোন।
আলমডাঙ্গাসহ জেলার সর্বত্র স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের হাতে হাতে এখন মোবাইলফোন। তবে এসব মোবাইলের মাধ্যমে শিশুরা যে শুধু তার পরিবারের সদস্য, শিক্ষক ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছে তা নয়, একই সাথে এর মাধ্যমে তারা পর্ণোছবির প্রতিও আসক্ত হয়ে পড়ছে। আসক্ত হচ্ছে ফেসবুক, ম্যাসেজিং ও ভিডিও কলের অপব্যবহারে। মোবাইলফোনের মাধ্যমে অল্প বয়সী শিক্ষার্থীরা নিজেদের তোলা আপত্তিজনক ছবি ইন্টারনেটে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অবাক হলেও সত্য যে, অভিযোগ রয়েছে শিশু শিক্ষার্থীদের মোবাইল হ্যান্ডসেট কিনে দেয়ার আবদার পূরণ করছেন খোদ অভিভাবকরাই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি প্রযুক্তি নিয়ে শিশু-কিশোরদের অতি আগ্রহ, মোবাইলফোনের সহজলভ্যতার কারণে শিশুদের মধ্যে মোবাইলফোন নিয়ে গরীবের ঘোড়া রোগের মতো অযথা চাহিদা তৈরি হয়েছে। শিশুদের দ্বারা মোবাইলফোনের অপব্যবহার হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। শ্রেণিকক্ষে বা কোচিংয়ে পড়তে গিয়ে মোবাইলফোনে সংযুক্ত ক্যামেরা দিয়ে স্কুল-কলেজের ছেলে শিক্ষার্থীরা তুলছে সহপাঠী মেয়ে শিক্ষার্থীদের ছবি। পরে ছবিগুলো অপব্যবহার করে আপত্তিজনকভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে অন্য সহপাঠীদের মোবাইলফোন ও ইন্টারনেটে। মেয়ে শিশু ও কিশোরীদের অবস্থাও নাজুক। হঠাত মোবাইলফোন হাতে পেয়ে কৌতুহলবশত অবুঝ মেয়ে শিক্ষার্থীরা স্বল্প সময়ের কথোপকথনে অপরিচিতদের সাথে জড়িয়ে পড়ছে প্রেমের সম্পর্কে। এদের অনেকে পরবর্তীতে ফোনে কথা বলা যুবকের সাথে দেখা করতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। হচ্ছে প্রতারিত। সবচেয়ে’ ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা পর্নোগ্রফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। যুক্তরাজ্যের ক্যামবিজ ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পর্ণোগ্রাফি আসক্তি মাদকের চেয়েও ভয়ানক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
আলমডাঙ্গার বেশ কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও শ্রেণিকক্ষে মোবাইলফোন ব্যবহার করছে। শিক্ষার্থীদের হাতে পরিচিত ব্র্যান্ডের দামি মোবাইলফোন দেখা গেছে। তাদের সাথে কথা হলে শিক্ষার্থীরা জানায়, মা-বাবার কাছে আবদার করেই মোবাইলফোন কিনেছে। কেউ পরিবারের কোনো সদস্যের মোবাইলফোন ব্যবহারকারীকে না জানিয়েই লুকিয়ে ক্লাসে নিয়ে এসেছে। ২ বছর পূর্বে উপজেলার ডামোশ গ্রামের স্কুল পড়ুয়া এক ছাত্র মোবাইলফোন না পেয়ে আত্মহত্যার অপচেষ্টা করেছিলো।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানায়, তার শ্রেণিতে কমপক্ষে ১০-১২ শিক্ষার্থী প্রতিনিয়ত মোবাইল ফোনসেট ব্যবহার করে। এ শিক্ষার্থীরা ক্লাসের বিরতিতে কিংবা টিফিন টাইমে লুকিয়ে মোবাইলফোনে কথা বলে। ফেসবুক ব্যবহার করে। এদের অনেকেই আবার ফেসবুকে খারাপ ছবিও দেখে এবং অন্যদের দেখাতে উৎসাহিত করে।
নাম সন্ধ্যাতারা (ছদ্মনাম)। আলমডাঙ্গা শহরের নিকটবর্তী গ্রামে বাড়ি। ঢাকার একটি নামসর্বস্ব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সে। ভালো পড়াশোনা করার জন্য গ্রাম থেকে ঢাকায় পাঠানো হয় তাকে। তার বাবা একজন দরিদ্র কৃষক। প্রতি মাসে মেয়েকে বহু কষ্ট করে পড়াশোনার জন্য টাকা পাঠান। অভাবের সংসার তারপরেও মেয়ের দাবি অনুয়ায়ী পড়াশোনার খরচসহ দামি একটি ফোনও কিনে দেয়া হয় তাকে। মা-বাবা জানে তাদের সন্তান ঢাকাতে ভালো পড়াশোনা করছে কিন্তু বাস্তবতা ভিন্নরূপ। তাদের সন্তান পড়াশোনা করার বদলে মোবাইলফোনে পরিচয়ের মাধ্যমে এক ছেলের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। মেয়েটি শেষাবধি ছেলেটিকে বিয়ে করেছে। অথচ এ বিয়ের কিছুই জানতো না তার পরিবার। একমাত্র সন্তানের এ ঘটনা জানতে পেরে মা-বাবা এখন পাগলপ্রায়। এমন ঘটনা যেনো এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, মোবাইলফোনে প্রেমের ভয়ঙ্কর নানা কাহিনী। এতে দারুনভাবে বিপথে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি নানা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে তারা। তাদের বন্ধুদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানিয়েছে, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থী তাদের ফেসবুক বন্ধুর সাথে নিয়োমিত ডেটিং করে থাকে।
এক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জানিয়েছেন, বর্তমানে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী যখন সে মাধ্যমিকের নীচের শ্রেণিতে পড়ত, ওই বয়সেই এক সহপাঠী মেয়ের সাথে প্রেম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। দৈনিক রাতে তারা পড়ার পরিবর্তে মোবাইলফোনে কথোপকথন চালাত গভীর রাত অবধি। এক পর্যায়ে মেয়েটির মা জেনে যায় সে প্রেমের ঘটনা। মেয়ের নিকট থেকে মোবাইলফোন কেড়ে নেন। ছেলেটি নতুন মোবাইল কিনে গোপনে প্রাইভেট পড়ার সময় আবার মেয়েটিকে দেয়। আবার রাতে লেখাপড়ার পরিবর্তে তারা মোবাইলফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিষয়টি আবারও মেয়েটির মা জেনে যায়। শুরু হয় তুলকালাম কা-। ছেলেটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেন। সে উদ্যোগ সামলে নেন ওই শিক্ষক। ছেলেটি ছিলো ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে প্রথম ছিলো। অথচ ক্লাস ৮ম শ্রেণিতে তার ক্রমিক নং হয় ১০। ওই শিক্ষক অনেক চেষ্টার পরও ছেলেটিকে ভালো করতে পারেনি। যথারীতি ছেলেটি এসএসসিতে খারাপ ফলাফল করলো। ভালো ছাত্র হওয়ায় শিক্ষকের দুর্বলতা ছিলো ওই ছাত্রের পরে। ইন্টার পড়ার সময় মেয়েটি অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুললে ছেলেটি একেবারে ভেঙে পড়ে। ভাগ্যিস সেই দুঃসময়ে শিক্ষক ছেলেটির সাথে ছিলেন।
শিক্ষক রবিউল ইসলাম জানান, আজকাল মোবাইলফোন অধিকাংশ শিক্ষার্থীর হাতে দেখা যায়। তারা পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। দেখা যায় রাত জেগে ফোনে কথা বলে নতুবা ফেসবুক দেখে। তারা মূল্যবান সময় নষ্ট করে বিপথগামী হচ্ছে। পড়াশুনার পেছনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল ফোন। এর সঠিক ব্যবহার না করে ছাত্র-ছাত্রীরা খারাপ দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিষয়টি চেষ্টা করেও নিয়ন্ত্রণে আনা অনেকটা সম্ভব হচ্ছে না।
ইংল্যান্ডের চারটির শহরের স্কুলে জরিপ চালিয়েল দেখা গেছে মোবাইলফোন নিষিদ্ধের পর ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের ফলাফলে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। লন্ডন স্কুল অফ ইকনোমিক্স এই সমীক্ষাটি প্রকাশ করেছে।
গ্রামীণফোনের কমিউনিকেশন বিভাগের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে ১৮ বছরের কম বয়সীদের মোবাইল হ্যান্ডসেট ব্যবহার অবৈধ। জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া কোম্পানিগুলোর মোবাইল হ্যান্ডসেট বিক্রি করার নিয়ম নেই। তাহলে অপ্রাপ্তবয়স্করা তাহলে কীভাবে মোবাইলফোন ব্যবহার করছে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কিছু উৎসাহী শিশু-কিশোর তাদের মা-বাবাকে মোবাইলফোন কিনে দিতে বাধ্য করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আলমডাঙ্গা শহরের এক ফ্লেক্সিলোড ও সিম বিক্রেতা ব্যবসায়ী বলেন, আইন মেনেই সিম বিক্রি করা হয়। নিয়মানুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সীদের কাছে সিম বিক্রি হয় না। কিন্তু বাইরের ছোট দোকানগুলোতে ব্যবসায়ীরা বয়স যাচাই-বাছাই না করেই লাভের আশায় সিম বিক্রি করেন।
শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র বাংলাদেশের সভাপতি আতিকুর রহমান ফরায়েজী বলেন, বিশ্বায়নের এ যুগে ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমকে কোনো অবস্থাই বাদ দেয়া সম্ভব নয়। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য পড়াশুনারও চর্চার ব্যবস্থা। এর ভালো দিকটি বোঝার বয়স শিক্ষার্থীদের হতে হবে। পৃথিবীর কোনো দেশেই অবাধে শিশু-কিশোরদের মোবাইলফোন ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। ভারতবর্ষেও আইন রয়েছে ষোলো বছরের নিচে শিশু-কিশোররা ইন্টারনেট ও ফেসবুক ব্যবহার করতে পারবে না। আমাদের দেশে তো সরকারের হাতে পর্নো ওয়েবসাইটগুলো নিয়ন্ত্রণের সুযোগ রয়েছে।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল আজিজ বলেন, কিশোর-কিশোরীরা মোবাইলফোনে ইন্টারনেট প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে অল্প বয়সেই যৌন আচরণে প্রলুব্ধ হচ্ছে, ফলে তারা সুস্থ বিনোদন থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে।