চুয়াডাঙ্গার প্রাণকেন্দ্র চৌরাস্তার মোড় : শহীদ হাসান চত্বর

উজ্জ্বল মাসুদ/রহমান রনজু: সকাল হওয়ার অনেক আগেই যে শহীদ হাসান চত্বর জেগে ওঠে মানুষের পদচারণায়, সেই চত্বর ঘুমায় কখন? তা জানতেই গতরাতে অপলক দৃষ্টিতে দুজন সাংবাদিকের পদার্পণ।

চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র শহীদ হাসান চত্বর। এ চত্বরকে কেউ বলেন চৌরাস্তার মোড়, কেউ বলেন বড়বাজারের বড়মোড়। এ মোড় ঘেঁষেই সদর থানা। মাথাভাঙ্গা ব্রিজ। নিচের কাঁচাবাজার। ফেরিঘাট রোড। পুরাতন গলি। দৈনিক মাথাভাঙ্গা’র প্রধান দফতর দীর্ঘ ২৬ বছর ছিলো এই শহীদ হাসান চত্বরেরই আশপাশে। ১৭ মার্চ থেকে রেলওয়ে স্টেশনের নিকটস্থ গম-চালপট্টি পেরিয়ে মনোরম পরিবেশে মাথাভাঙ্গার নিজস্ব স্থাপনাতেই স্থানান্তর হয় প্রধান কার্যালয়। এ কার্যালয় থেকে রাতের শহীদ হাসান চত্বর দেখতে দুজন সাংবাদিক যখন ছোটেন, তখন ঘড়ির কাঁটা সোয়া ১১টা। বাহক মোটরবাইক।

শহীদ হাসান চত্বরের পাশেই মুক্তমঞ্চ। তার নিকট শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধ। থানার কোলঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে মসজিদ। কয়েক কদম দূরেই মাথাভাঙ্গা নদী। এর অদূরেই চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। তার পশ্চিমে নদী। এর তীরে এক সময়ের প্রস্তাবিত বিনোদন কেন্দ্রেই হরিজন সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকজন সদস্যের বসবাস। সন্ধ্যার পর সেখানে দিব্যি চলে মদ বেচার মহোৎসব। শুধু কি ওই বাড়িতে? ব্রিজের অপর প্রান্তে কাঁচাবাজার পানের হাটের ঘুপচিতেও ঘুর ঘুর করে চিহ্নিত কয়েক মদ বিক্রেতা। গতরাত সাড়ে ১১টার দিকে শহীদ হাসান চত্বরে পৌঁছেও নাকে ঠিকই পৌঁছুলো মূত্র আর বাংলা মদের দুর্গন্ধ। শহীদ হাসান চত্বরের পাশেই সোনালী ব্যাংক। ওই ব্যাংকের পাঁচিলটা দীর্ঘদিন ধরে গণসৌচাগার হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এখন সেখানে বিজলিবাতি। সার্বক্ষণিক নগদ টাকা তোলার ঘর। পোশাক পরা নৈশপ্রহরী। ফলে সেখানেও এখন আর মলমূত্রত্যাগের সুযোগ নেই। তাহলে? দিনে বা রাতে চুয়াডাঙ্গার প্রাণকেন্দ্র চৌরাস্তার মোড়ে মল-মূত্র ত্যাগের বেগ পেয়েছেন তো মরেছেন! নির্ঘাত কাপড় নষ্টের ঝুঁকি। অবশ্য মাঝরাতে এখন ঝুঁকির মাত্রা বহুলাংশেই হ্রাস পেয়েছে। কেননা, রাত ১২টা বাজলেই দোকানপাট বন্ধের নির্দেশ। সদর থানার বর্তমান বড় বাবু যেদিন থেকে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় যোগ দিয়েছেন, সেদিন থেকেই শহরের শুধু শহীদ হাসান চত্বর নয়, সকল সড়কের সকল দোকান বন্ধের নির্দেশ জারি হয়েছে। এতে অপরাধীদের অপতৎপরতা কমেছে না বেড়েছে তা শহরবাসীই সাক্ষী। তবে দূর-দূরান্ত থেকে ফেরা দূরপাল্লার কোচগুলো যখন চৌরাস্তার মোড়ে পৌঁছায় তখন ভূতুড়ে পরিবেশ। যার চেহারা দেখে চমকাতে হয় আগতদের। কেননা, শহর নাকি গ্রাম তা বোঝা ভার। দীর্ঘযাত্রা শেষে বাস থেকে নামার পর প্রাকৃতির ডাকটা অধিকাংশের ক্ষেত্রেই পড়ে। অথচ সুব্যবস্থা না থাকায় হয় চেপে রাখতে হয়, নয় ছুটতে হয় নিচের বাজারের পৌর সৌচাগারের দিকে। যদিও ওখানে রাত-বিরেতে মহিলাদের নেয়া বড্ড ঝুঁকি। বউ-বোন হারানোর ভয় পদে পদে। কেননা, ওই সৌচাগারের আশপাশে মাংসপট্টিতেও চলে অবাদে মদ কেনা-বেচা। মদের আসর, মাতলামি।

মোড়ে সন্ধ্যার পরপরই রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টের নিচে ডিম, ফুচকা আর ভাজাভুজি বিক্রির ধুম পড়ে। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে কমে যায় ওসব কেনা-বেচা। জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র রাতে কেমন যেন প্রাণহীন হয়ে পড়ে। ঘুর ঘুর করে বেশ ক’জন ভ্রাম্যমাণ পতিতা। হাসান চত্বরের আইল্যান্ডের পাশেই পড়ে ঘুমায় কিছু বেওয়ারিশ কুকুর। মাঝে মাঝে ওদের উপস্থিতি এতোটাই বেড়ে যায় যে, তা দেখে ওদের কুকুরের সমাবেশ বললে ভুল বলা হয় না। তাছাড়া বিবেকহীন গোয়ালিনীর কয়েকটি গরু নেদে-টেদে একাকার করে রাখে জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র শহীদ হাসান চত্বর। সুযোগ পেলে বসে একটু জাবরও কেটে নেয় ওরা। আর ভ্রাম্যমাণ পতিতা? আশপাশের নৈশপ্রহরীরাই ওদের আশ্রয়দাতা। এ অভিযোগ নতুন নয়। হাসান চত্বরের আশপাশে যেমন মদ বেচা বিক্রি আর মাতলামি লেগেই থাকে, তেমনই ভ্রাম্যমাণদের ঘোরাফেরার দৃশ্যও হরহামেশাই চোখে পড়ে। গতরাতেও ছিলো অভিন্ন চিত্র। একজন নৈশপ্রহরী আমাদের দুজনকে দেখে কাছে এসে হাতের গামছাটা ঘুরিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে বললেন, বৃষ্টির কারণে যেমন গরমটা কম, তেমনই মশার উপদ্রবও কমেছে। তা না হলে মশার ভনভনানিতে দুই দণ্ড দাঁড়ানোই যেন দায় হয়ে দাঁড়ায়। আপনাদের কিছু লাগবে ভাই? নৈশপ্রহরী আমাদের যে ওদের খোদ্দের ভেবেছিলেন তা ওই প্রশ্নেই স্পষ্ট।

রাত ১২টা বাজার কিছুক্ষণ আগে দোকান বন্ধ করতে করতে  নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চা দোকানি বললেন, নতুন ওসি স্যার আসার আগে সারারাতই দোকান খোলা থাকতো। কয়েকজন কর্মচারী নিয়ে ভালোই চলতো। এখন রাত ১২টা বাজতে না বাজতেই ঝাপ বন্ধ। রিকশাওয়ালারও চলে যান রেলস্টেশনে। শহীদ হাসান চত্বরটা বড় একা হয়ে যায়। তখনই বোধ হয় ঘুমায় চৌরাস্তার মোড়। অবশ্য নৈশকোচ, কোচের কিছুযাত্রী, আর টহল পুলিশের পিকআপের ঘোরঘুরিতে কি শহীদ হাসান চত্বরের আয়েশ করার উপায় আছে? না, গতরাতেও শহীদ হাসান চত্বরের আয়েশ ছিলো না। দাপাতে দেখা গেছে বেশ ক’জন মাতালকে। ঘুরতে দেখা গেছে মাঝরাতের কয়েক রমণীকে। অবাক হলেও সত্য, ওদেরও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে মারণব্যাধি ছড়ানোর ঝুঁকি অলিগলির শিরা-উপশিরায়। গতরাতেও নিচের বাজারের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মর্জিনা নামের একজনকে খদ্দেরের সাথে কথা বলতে দেখা গেছে। তখন রাত সাড়ে ১২টা। রাত ১টার দিকে এক মাতাল নিজেকে সৎ চরিত্রের বলে দাবি করে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। স্রোতার অভাবে বেচারা শহীদ হাসান চত্বর ছেড়ে বাড়ির দিকেই বোধ হয় রওনা হলেন। দু সাংবাদিক যখন শহীদ হাসান চত্বর ছেড়ে মাথাভাঙ্গা কার্যালয়ের দিকে, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ১টা। ওই সময় টহল পুলিশের পিকআপ ছিলো না। দূরপাল্লার নৈশকোচ থেকে নামা এক নারীসহ কয়েক যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন রাস্তার পাশে। তাদের চোখে মুখে ছিলো অনিশ্চয়তার ছাপ। একজন বললেন, একটা দোকানও যদি খোলা থাকতো তাহলে না হয় সেখানে বসা যেতো। তবে শহীদ হাসান চত্বরের কয়েকটি হোটেলের আংশিক খোলা থাকতে দেখা গেলেও তা চলছিলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ। দিনে যেখানে দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যায় না, রাতে সেখানে ভিন্ন চিত্র। ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুনশান নিরবতা।

চুয়াডাঙ্গা শহীদ হাসান চত্বরের ল্যাম্পপোস্টগুলোর অধিকাংশেরই বিজলিবাতি বন্ধ ছিলো। তবে নিচের বাজারের দিকে ল্যাম্পপোস্টের বাতিটা বেশ জায়গাজুড়ে আলোকিত করে রেখেছে। সেখানে থাকা এক রিকশাচালক বললেন, চুয়াডাঙ্গা শহীদ হাসান চত্বর মাঝরাতে মরা। ওই জনতা ফার্মেসিই যেন জাগিয়ে রেখেছে শহরটা। যেকোনো প্রকারের ওষুধের জন্য সত্যিই এক নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। রাতে বিপদের সাথী। কয়েকটি চা দোকান যদি পেতেন রাতে দোকান খোলার অনুমতি, তাহলে হয়তো দূর হতো ভূতুড়ে পরিবেশ।

প্রসঙ্গত, জগতে এমন কিছু জায়গা থাকে যে জায়গাগুলোকে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা বিরামহীনভাবে জেগে থাকতে হয়। মানুষ জাগিয়ে রাখে মানুষের স্বার্থে। চুয়াডাঙ্গা শহীদ হাসান চত্বর সার্বক্ষণিক জাগিয়ে রাখার তাগিদ যেন সেখান থেকেই। রাতের চুয়াডাঙ্গা দেখার আজ তিন পর্ব। আগামীকাল থাকছে ৪র্থ পর্ব।