চুয়াডাঙ্গার ডায়াগনস্টিক ও বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবাদান কেন্দ্রগুলোর অধিকাংশেই সরকারি বিধি অবজ্ঞা

কিছু ক্লিনিক নার্সিং হোমে চিকিসা সেবার নামে চলছে যাইচ্ছে তাই : তীব্র যন্ত্রণায় কাতর শিরিনা অবশেষে পেলেন রেহায়
স্টাফ রিপোর্টার: নিরাময় নার্সিং হোমে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করা প্রসূতি শিরিনা খাতুনকে (১৯) শেষ পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তীব্র যন্ত্রণায় কাতরানোর এক পর্যায়ে গতপরশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সিজারের ২৩ দিনের মাথায় গতকাল বৃহস্পতিবার হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে পুনঃঅস্ত্রোপচার করে টানা তিন ঘণ্টা ধরে শরীরের প্রায় দু’লিটার পচারক্ত বর্জ বের করা হয়েছে।
ক্লিনিক, নার্সিং হোম বা বিভিন্ন নামে বেসরকারি হাসপাতাল চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর অধিকাংশের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকরই শুধু নয়, সরকারি বিধির ন্যূনতমও মানা হয় না বলেই সুস্থতার বদলে বহুরোগীর বাড়ে দুর্ভোগ। কারো কারো জীবন প্রদীপ অকালেই ঝরে পড়ে। চিকিৎসকদের অনেকে অজুহাতে পার পেলেও স্বাস্থ্য সচেতনমহলে ক্ষোভের মাত্রা বাড়তেই থাকে। এরই মাঝে চুয়াডাঙ্গার বর্তমান জেলা প্রশাসক জেলার বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবাদান কেন্দ্রগুলোতে সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি বিধি মেনে চলার তাগিদ দিয়ে এক মাসের জন্য সময় বেধে দেন। অবাক হলেও সত্য যে, একমাসের স্থলে দু’মাস পার হলেও বহু ক্লিনিক, নার্সিং হোম বা বেসরকারি হাসপাতাল যেমন ন্যূনতম লাইসেন্স নেয়নি, তেমনই ডায়াগনস্টিকগুলোর অধিকাংশেই সার্বক্ষণিক থাকেন না স্বীকৃত পরীক্ষক। আর ক্লিনিকগুলোতে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক? ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী সেবিকাই যেখানে দেখা মেলে না সেখানে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক পাওয়ার আশা করাই তো অবান্তর। শিরিনা খাতুন নামের যে প্রসূতিকে নিরাময় নার্সিং হোমে ড্রেসিংটাও একজন নারী করেননি। করেছেন ফারুক আর মুক্তার নামের দু’ব্যক্তি। এদের দক্ষতার সনদ দূরের কথা দেশ ক্লিনিক নামের এক পরিচালক শান্ত তো কয়েকটি ক্লিনিকে গিয়ে অপারেশনও করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের তিতুদহের খেজুরতলা পশ্চিমপাড়ার রবিউল ইসলামের মেয়ে শিরিনা খাতুন পার্শ্ববর্তী হরিণাকু-ুর ছোট ভাদরা দক্ষিণপাড়ার নয়নের স্ত্রী। অন্তঃসত্ত্বা শিরিনা খাতুনের প্রসব বেদনা দেখা দিলে তাকে নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গায়। গত ১৩ জানুয়ারি চুয়াডাঙ্গার নিরাময় নার্সিং হোমে ডা. মশিউর রহমান সিজার করেন। পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। ৫দিন ওই নার্সিং হোমে রাখার পর ছাড়পত্র দেয়া হয়। যন্ত্রণা থেকেই যায়। ৫দিন পর নার্সিং হোমে নিয়ে রোগীর ড্রেসিং করেন ফারুক ও মুক্তা। এরপর যন্ত্রণার মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। ঘটনার ২৩দিনের মাথায় ওই ডাক্তার মশিউরের নিকট রোগীর বর্তমান অবস্থার কথা বলা হলে তিনি হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। গাইনি কনসালটেন্ট ডা. আকলিমা খাতুন প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করান। সিজারিয়নের সময় ত্রুটিসহ নানা কারণে ইনফেকশনের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর রোগীর শরীরে আবারও অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গতকাল ডা. তারিক হাসান শাহীন সহকর্মীদের সাথে নিয়ে টানা প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে অস্ত্রোপচার করে উল্পে-পাল্টে থাকা নাড়িসহ ভেতরে ইনফেকশনের বর্জ বের করেন। প্রায় আড়াই লিটার পুজ অপসারণের পর অবাক চিকিৎসক বলেন, সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। আশা করি রোগী এবার সুস্থ হয়ে উঠবেন।
ক্লিনিক নার্সিং হোমে একের পর এক এ ধরনের ঘটনার পরও জেলা স্বাস্থ্য প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরেই রহস্যজনক নীরবতা পালন করে আসছে। এরই মাঝে জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদ জেলার সকল ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিক নার্সিং হোমসহ বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রের স্বত্বাধিকারীদের নিয়ে বৈঠকে মিলিত হন। এক মাসের মধ্যে সকল ত্রুটি সারিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে জেলা প্রশাসক স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দেন, এরপর কোনো ত্রুটি মেনে নেয়া হবে না। অথচ এখনও চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল সড়কের অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক, আলমডাঙ্গা হারদীর খান লাইফ কেয়ার, হারদী ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হারদীর এসএস ডায়াগনস্টিক, আলমডাঙ্গা কলেজ রোডের খন্দাকার ডায়াগনস্টিক, দামুড়হুদা কার্পাডাঙ্গার সেবা ডায়াগনস্টিক, রোজ ডায়াগনস্টিক, জীবননগরের নোভা ও হাসাদাহ ডায়াগনস্টিক অনুমোদন ছাড়াই চলছে দিব্যি। আর চুয়াডাঙ্গার লাইসেন্সপ্রাপ্ত ৪১টি ডায়াগনস্টিকের অধিকাংশেই মানা হয় না বিধি। ফলে ভুল রিপোর্টে অপচিকিৎসার শিকার হতে হচ্ছে অনেকের। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা জেলার ৪৫টি ক্লিনিক নার্সিং হোম বা বেসরকারি হাসপতালের অধিকাংশেই থাকেন না সার্বক্ষণিক চিকিৎসক। অথচ একজন এমবিবিএস চিকিৎসক থাকা বাধ্যতামূলক। যা আছে খাতা কলমে। ৩ শিফটে ২ জন করে মোট ৬ জন ডিপ্লোমা নার্স থাকার কথা থাকলেও চুয়াডাঙ্গার কোনো ক্লিনিকে কি তা দেখা মেলে? অনিয়মের কারণেই একের পর এক রোগীকে শুধু দুর্ভোগের শিকারই হতে হচ্ছে না, জীবনটাই বিপন্নের ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। ফলে জেলা প্রশাসক এদিকে বিশেষ নজর দেবেন বলে স্বাস্থ্য সচেতনমহল আশা করছে।