চুয়াডাঙ্গার খাসপাড়ায় স্ত্রীর সাথে পরকীয়ার সন্দেহে চাচাতো ভাইয়ের হাতে ভাই খুন

পাটের জাগের নিচ থেকে রিপনের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার ॥ খুনি মঈনসহ গ্রেফতার ৫
নজরুল ইসলাম: চুয়াডাঙ্গার খাসপাড়ায় রিপন সরকার নামের এক মাছচাষিকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। স্ত্রীর সাথে পরকীয়ার সন্দেহে গ্রামের মঈন ও তার এক বন্ধু মিলে রোববার রাতে তাকে হত্যা করে। হত্যার পর রিপন সরকারের লাশ গুম করতে পাটজাগের নিচে লুকিয়ে রাখে হত্যাকারীরা। স্থানীয় মানতেগাড়ির বিল থেকে সোমবার সকালে রিপন সরকারের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত রিপন সরকার গ্রামের মোতালেব সরকারের ছেলে। এ খুনের নায়ক মঈন প্রধানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পরিবারের তিন নারীসহ আরও ৪ জনকে আটক করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অকপটে খুনের কথা স্বীকার করেছে মঈন এবং খুনের কাজে ব্যবহৃত রামদা উদ্ধার করেছে পুলিশ। খুনের সাথে আরও কারা জড়িত আছে তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তবে এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় মামলা দায়ের না হলেও ময়নাতদন্ত বেদনাবিধূর পরিবেশে রিপনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
পুলিশ ও এলাকাসূত্রে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার খাসপাড়া গ্রামের মোতালেব সরকারের ছেলে রিপন সরকার (৩০) স্থানীয় মানতেগাড়ির বিল সংলগ্ন একটি পুকুরে মাছ ছেড়েছেন। রোববার রাত সাড়ে ৮টার দিকে তিনি ওই পুকুর পাহারা দিতে যান। রাতে তাকে আর পাওয়া যায়নি। সকালে রিপনকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। বিলের ধারে রক্ত এবং ধস্তাধস্তির চিহ্ন এবং স্যান্ডেল ও টর্চলাইট দেখে এলাকাবাসীর সন্দেহ হয়। এরপর একটি পাটজাগের নিচে রিপনের লাশ পাওয়া গেলে স্থানীয়রা পুলিশে খর দেয়। বেলা সাড়ে ৯টায় পুলিশ রিপন সরকারের লাশ উদ্ধার করে। স্ত্রীর সাথে পরকীয়া সন্দেহে বিভিন্নভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে নির্মমভাবে খুন করলো চাচাতো ভাই রিপনকে।
গ্রামবাসি জানায়, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নবগঠিত গড়াইটুপি ইউনিয়নের খাসপাড়া গ্রামের সরকার পাড়ার ছামছদ্দিন প্রধানের ছেলে মঈন প্রধান গত ৫ মাস আগে মালয়েশিয়া থেকে বাড়ি আসে। মালয়েশিয়ায় থাকাকালীন স্ত্রী এক সন্তানের জননী মৌসুমি খাতুনের সাথে মোবাইলফোনে চাচাতো ভাই মোতালেব সরকারের ছেলে রিপন সরকারের পরকীয়া ছিলো বলে মঈন অভিযোগ তোলে। এ নিয়ে গ্রামে একাধিকবার সালিস বৈঠকও হয়। স্ত্রীর সাথে পরকীয়ার বিষয়টি ভুলতে পারে না মঈন। মঈন রিপনকে ফাঁসানোর জন্য একের পর এক চেষ্টা চালাতে থাকে। তার মধ্যে ভুট্টার গাদায় আগুন, পুকুরের ধারে অস্ত্র-বোমা রাখাসহ মোবাইলফোনে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিধামকি তো আছেই। মঈন এবং রিপনের বিরোধটি সকলে অবগত ছিলো। এদিকে গত কয়েক থেকে রিপন খাসপাড়া গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে গোলাম মোস্তফার সাথে ভাগে গ্রামের বিভিন্ন পুকুর লিজ নিয়ে মাছচাষ করে আসছিলো। রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে পুকুর পাহারা দিয়ে গ্রামের মনির দোকানে চা খেয়ে বাড়ি ফিরছিলো রিপন। সকাল পর্যন্ত বাড়িতে না ফেরায় প্রশাসনকে জানানোসহ রিপনকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে পরিবারের লোকজন। সকাল ৬টার দিকে রাস্তার পাশে ঝোপঝাড়ে রক্তের দাগ এবং পায়ের স্যান্ডেল ও টর্চলাইট পড়ে থাকতে দেখে পরিবারের লোকজন। রক্তের দাগের সন্ধান চালাতে গিয়ে মানচে গাড়ির বিলে পাটের জাগের নিচে খোঁজাখুঁজি শুরু করে পরিবারের লোকজন। একপর্যায় পাটের জাগের নিচে হত্যা করে গুম করা রিপনের (৩০) লাশের সন্ধান মেলে। খবর পেয়ে তিতুদহ ক্যাম্প পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে রিপনের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে। রিপনের শরীরে বিভিন্ন জায়গায় কোপের দাগসহ খোচানোর দাগ রয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উদ্ধারকৃত লাশ ময়নাতদন্তের জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে প্রেরণ করে পুলিশ। এদিকে রিপনকে খুন হয়েছে এমন সংবাদ পেয়ে মঈনের মা মর্জিনা বেগম, স্ত্রী মৌসুমি খাতুন ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রী শান্তনা খাতুন ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাড়ি থেকে পালাতে গেলে গ্রামের লোকজন তাদেরকে আটক করে। তবে ঘটনার রাতেই মঈন, তার পিতা ছামছদ্দিন ও ছোট ভাই খোকন বাড়ি ছিলো না।
রিপনের মা বাবা ও স্ত্রী অভিযোগ করে বলেন, রিপনকে পূর্বশত্রুতার জের ধরে পূর্বপরিকল্পিতিভাবে হত্যা করেছে মঈনের পরিবারের লোকজন। হত্যার পর লাশ গুম করার জন্য পাটের জাগের নিচে লুকিয়ে রেখে ছিলো। মঈন মালয়েশিয়ায় থাকা এবং বাড়িতে ফিরে এসে রিপনকে ফাঁসানোর অনেক চেষ্টা চালিয়েছে। যা গ্রামের অনেকেরই জানা। রিপন মঈন বিরোধ নিয়ে গ্রামে একাধিকবার সালিসও হয়েছে। সালিসের পর রিপন মন থেকে বসকিছু মুছে ফেললেও মঈন তা ভুলতে পারেনি। রিপনকে মেরে ফেলোর হুমকিধামকি মোবাইলে রেকর্ডিং আছে। যা পুলিশকে দেয়া হয়েছে। রিপনের ব্যবসায়িক পাটনার গোলাম মোস্তফা বলেন, সর্বশেষ পুকুর পাহারা দিয়ে দোকানে চা খেয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয় রিপন। সকালে রিপনের মা মোবাইলে জানান সে বাড়ি ফেরেনি। তখন থেকে প্রশাসনকে জানানো এবং খোঁজাখুঁজি করতে থাকি। তিনি আরও বলেন, কয়েকদিন আগে আমাদের লিজ নেয়া পুকুরের ধারে বোমা এবং পিস্তল সাদৃশ বস্তু রেখে রিপনকে ফাঁসানোর চেষ্টা চালায় মঈন। যা গ্রামের অনেকেই জানে। এটা একটা পরিকল্পিত হত্যা। এদিকে ঘটনার পরপরই চুয়াডাঙ্গা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন, সদর (সার্কেল) তরিকুল ইসলাম, সদর থানার অপারেশন অফিসার আমির আব্বাস, ডিবি পুলিশের এসআই ইব্রাহিম, আশরাফ আলী ঘটনাস্থলে পৌঁছান।
এ সময় আব্দুল মোমেন বলেন, প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি মঈনের সাথে রিপনের পারিবারিক বিরোধ আছে। খুনটি হয়তো সেখান থেকেই ঘটতে পারে। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অপরদিকে দুপুর সাড়ে ১২টার তিুতদহ ক্যাম্প পুলিশ বাটিকাডাঙ্গা গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়া মঈনের পিতা ছামছদ্দিনকে আটক করে। আর বিকেল ৪টার দিকে ডিবি পুলিশের এসআই ইব্রাহিম ও আশরাফ আলী সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে খুনের মূলহোতা মঈনকে (৩২) জীবনগরের পেয়ারাতলা থেকে গ্রেফতার করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত মঈন খুনের কথা অকপটে যেমন শিকার করেছে তেমনি খুনের কাজে ব্যবহৃত রামদা সড়াবাড়িয়ার একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় খুনের মূলহোতা মঈনসহ পরিবারের ৫ সদস্য পুলিশ হেফাজতে রয়েছে। খুনের সাথে আর কারা জড়িত আছে সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। স্থানীয়রা জানান, মঈন কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় থাকতো। সেখানে অস্ত্র ব্যবসা করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। জামিন পেয়ে দু বছর আগে পানিপথে মালয়েশিয়ায় যায়। মালয়েশিয়া থেকে গত ৪ মাস আগে বাড়ি ফিরে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেয়। জামিনের পর থেকে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থেকে ইয়াবার ব্যবসা শুরু করে। ইয়াবার একটি বড় চালান পুলিশের হাতে ধরা পড়লে রিপনের দিকে সন্দেহের তীর তোলে মঈন। পুলিশ সঠিকভাবে তদন্ত করলে মঈন সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে স্থানীয়রা মনে করছে।
এদিকে গতকালই বিকেল ৫টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে রিপনের লাশ গ্রামে পৌঁছুলে গ্রামজুড়ে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জানাজা শেষে গ্রাম্য কবরস্থনে রিপনের দাফন সম্পন্ন হয়। অপরদিকে ৪ বোনের একমাত্র ভাই রিপন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানেকে হত্যা করায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে পরিবারের লোকজন।