চুয়াডাঙ্গার খাসপাড়ার রিপন খুনের ঘটনায় ৪ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের

মূলহোতা মঈনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ॥ নেপথ্যে নানা কাহিনি
বেগমপুর প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের নবগঠিত গড়াইটুপি ইউনিয়নের খাসপাড়ায় চাচাতো ভাইয়ের হাতে পরিকল্পিত ভাই খুনের ঘটনায় ৪ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় খুনের হোতা গ্রেফতারকৃত মঈনকে আদালতে সোপর্দ করেছে পুলিশ। বিজ্ঞ আদালতের বিচারকের নিকট মঈন খুনের কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। এ খুনের পেছনে রয়েছে নানা ঘটনা। স্ত্রীর সাথে মোবাইলে কথা বলার অপরাধসহ দীর্ঘদিনের পারিবারিক কলহের জের ধরে ক্ষোভের আগুনে ফুঁসছিলো মঈন। পরিকল্পিত খুনের মধ্যদিয়ে ক্ষোভের হবির প্রকাশ ঘটিয়েছে বলে এলাকাজুড়ে শোনা যাচ্ছে নানা গুঞ্জন।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নবগঠিত গড়াইটুপি ইউনিয়নের খাসপাড়া গ্রামের সরকার পাড়ার ছামছদ্দিন প্রধানের ছেলে মঈন প্রধানস্ত্রীর সাথে সম্পর্ক আছে সন্দেহে চাচা মোতালেব সরকারের ছেলে রিপনকে (৩০) রোববার রাতে পরিকল্পিতভাবে খুন করে। পরের দিন সোমবার সকাল ৬টার দিকে মানচে গাড়ির বিলের পাট জাগের নিচ থেকে রিপনের ক্ষত-বিক্ষত লাস উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার পরপরই খুনের সাথে জড়িত সন্দেহে মঈনের পিতা ছামছদ্দিন, মা মর্জিনা বেগম, স্ত্রী মৌসুমি খাতুন ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রী শান্তনা খাতুনকে আটক করে পুলিশ। ঘটনার ১২ ঘণ্টার মাথায় চুয়াডাঙ্গা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই ইব্রাহিম, আশরাফ আলী গোপন সংবাদের ভিত্তিত্বে খুনের হোতা মঈনকে জীবননগরের পেয়ারাতলা নামকস্থান থেকে গ্রেফতার করেন। এ ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার সকালে রিপনের সেজবোন নুরজাহান বেগম বাদী হয়ে ছামছদ্দিন ছেলে মঈন ও খোকন এবং সড়াবাড়িয়া গ্রামের আক্কাচ আলীর ছেলে নাজমুলকে আসামি করে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় মামলা করেন। আটককৃত খুনের প্রধান হোতা মঈন ও তার পিতা ছামছদ্দিনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হলেও মামলার আসামি না হওয়ায় মঈনের মা মর্জিনা বেগম, স্ত্রী মৌসুমী খাতুন ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রী শান্তনা খাতুনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেয় পুলিশ।
এদিকে মামলার তদন্তকারী অফিসার গোয়েন্দা পুলিশের এসআই ইব্রাহিম জানান, গ্রেফতারকৃত মঈনকে গতকালই বিকেলে আদালতে সোপর্দ করা হয় এবং সে বিজ্ঞ আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল হালিমের নিকট খুনের কথা শিকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। সে জানিয়েছে রিপনকে বাটাম দিয়ে প্রথমে সে আঘাত করেছে। আর নাজমুল জবাই করেছে। পরে দুজনে মিলে লাশ গুম করার উদ্দেশে পাটের জাগের নিচে লুকিয়ে রেখেছে। তবে ঘটনার পর থেকে এলাকায় নানা কথার গুঞ্জন শেনা যাচ্ছে। মঈন রিপনকে শুধুমাত্র স্ত্রীর সাথে কথা বলার কারণে খুন করেনি। দুটি পরিবারের মধ্যে দীর্ঘদিন বিরোধ চলে আসছিলো। মঈন খুব ডানপিটে ছিলো। তাই নবম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় তার পিতা-মাতা নানাবাড়ি ভেড়ামারায় পাঠিয়ে দেয় তাকে। সেখানে সে পড়াশোনা না করে অপরাধ জগতের সাথে মিশে যায়। ভেড়ামারায় অস্ত্র আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা হলে সেখান থেকে সে পালিয়ে এসে আড়াই বছর আগে ঘরে স্ত্রী রেখে পানি পথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমায়। স্ত্রী মৌসুমি খাতুনের সাথে চাচাতো ভাই রিপন মোবাইলে কথা বলে এমন সংবাদ পেয়ে গত রোজার ঈদের আগে সে বাড়িতে আসে। এ নিয়ে গ্রামে সালিসও হয়। তারপর থেকে রিপনের পিছু নেই সে। তাকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা করে মঈন। মঈনের পরিকল্পনার মধ্যে ছিলো ভুট্টার গাদায় আগুন দিয়ে পুলিশে খবর, বেগুন ক্ষেত কেটে পুলিশে খবর, সর্বশেষ ২১/০৮/১৭ তারিখে রিপনকে ফাঁসাতে তার লীজ নেয়া পুকুর পাড়ে একটি রিভালবার ও দু নলা একটি পাইপ গান রেখে পুলিশে খবর দেয়া। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন বুঝতে পেরে তার কথায় কর্ণপাত করে না।
রিপনের পিতা মোতালেব সরকার অভিযোগ করে বলেন, গত ১০ সেপ্টেম্বরে মঈন বেগমপুর বিলপাড়ার চাকরিচ্যুত সেনা সদস্য বসিরের সাথে ইয়াবাসহ বেগমপুর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পরে যাচাই-বাছাই করে ওই ইয়াবা বসিরের নিকট পাওয়ায় পুলিশ মঈনকে ছেড়ে দেয়। মঈন সন্দেহ করে রিপন পুলিশকে খবর দিয়ে তাকে ধরিয়ে দিয়েছে। যা আদৌ সত্য ছিলো না। মঈনের কোনো ঘটনা ঘটলেই সন্দেহ করে রিপনের ওপর দোষ চাপাতো। বেগমপুর পুলিশের নিকট থেকে মঈন বাড়িতে এসে রিপনকে প্রকাশ্যে খুন করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। মঈন পুলিশের নিকট স্বীকারও করেছে রিপন খন করার জন্য একসপ্তাহ ধরে সে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সুযোগ হয়ে উঠছে না। সে সুযোগটি এসে যায় রোববার রাতে। একটি সূত্র জানিয়েছে, মঈন এলাকার মানুষের সাথে খুব একটা মিশতো না। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো জীবননগর আন্দুলবাড়িয়ার জনৈক সুজায়েত, গবরগাড়ার আলম, সড়াবাড়িয়ার নাজমুলসহ অপরিচিত কয়েকজন। যারা প্রত্যেকে মাদকব্যবসায়ী। রিপন হত্যার পর থেকে অনেকেরই মনে প্রশ্ন জেগেছে, ঘটনার রাতে মঈন কয়েকবার সরকারপাড়া-খাসপাড়া সড়কে কয়েকজনকে সাথে নিয়ে ঘুরাঘুরি করেছে এবং রাত ৯টার দিকে মনির দোকানে চা খেতে গেছে। রিপন যখন তার সাড়ে ১১টার দিকে মনির চা দোকান থেকে বাড়ি যাবার উদ্দেশে রওনা দেয় তখন খবরটা কিভাবে মঈনের নিকট পৌঁছুলো। হত্যার পর সে বাড়িতে আসে এবং রিপনের লাশ পাট জাগের নিচে লুকানোর জন্য সাথে কয়েকজনকে নেই এবং পরনের ভেজা কাপড় চোপড় পাল্টায়। খুনের কাজে ব্যবহৃত রামদাটি সুন্দর করে কাগজে মুড়িয়ে পুকুরে লুকিয়ে রাখলো কাগজ পেলো কোথায় ? যদিও মঈন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে হত্যার অন্যতম আসামি নাজমুল ধরা পড়লে রিপন হত্যার প্রকৃত রহস্য উন্মোচন হবে বলে এলাকাবাসী মনে করছে। রিপনের বৃদ্ধ পিতা অভিযোগ করে বলেন, আমার ছেলে হত্যার সাথে মাত্র দুজন জড়িত ছিলো না। পুলিশ সঠিক তদন্ত করলে প্রকৃত ঘটনা জানতে পারবে। আমি আমার ছেলে হত্যার সুষ্ঠ বিচার চাই।