চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী গড়াইটুপি মেলার আর মাত্র ১১ দিন বাকি

 

 

ভাঙা হচ্ছে শত বছরের নিয়ম

স্টাফরিপোর্ট: শত বছরের নিয়ম ভেঙে এ বছর ৭ দিন আগেই শুরু হতে যাচ্ছে এতোদাঞ্চলের সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী তিতুদহের গড়াইটুপি অম্রাবতীর মেটেরি মেলা। ৭ আষাঢ় থেকে শুরু হবার কথা থাকলেও রমজান মাসের কারণে ১ আষাঢ় থেকে বসতে পারে এ মেলা। মেলাকে সামনে রেখে গোটা এলাকাই যেনো বিরাজ করছে আনন্দঘন পরিবেশ। পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে জুয়াড়িদের পদচারণা। গত বছরের ন্যায় মিউজিক আর ঢাকির ঢোলের তালে তালে কুরুচিপূর্ণ নৃত্য আর সর্ব প্রকার জুয়ার আসর বসার প্রস্তুতি চলছে না তো?এরই মাঝে মেলা এলাকায় অপরিচিত মানুষের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এলাকায় মোবাইলফোনে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণের মতো বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এদিকে ১১ জুন থেকে শুরু হতে যাচ্ছে মাধ্যমিক পর্যায়ের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা। অপর দিকে আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় শঙ্কিত এলাকার মানুষ। এ মেলাকে কেন্দ্র করে ২০০৯ সালে স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল লতিফকে সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হতে হয়েছিলো। এ মেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই কম বেশি অঘটন ঘটে থাকে। এদিকে সরকার ১০ শতক জমি ইজারা দিয়ে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করলেও মেলার উন্নয়নে নেয়নি কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ। ফলে এলাকাবাসীর দাবি বরাবরই হয়েছে উপেক্ষিত। তবে বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান আকতার হোসেন গত বছর প্রায় ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন একটি পাকা ঘর।

এলাকা ও আয়োজক সূত্রে জানাগেছে, মেলা বাঙালি জাতির একটি লোকজ ঐতিহ্য। মেলা উপলক্ষে বহু লোকের সমাগম ঘটে সেখানে, এটি মূলত গ্রামের মানুষের শিল্প ও সংস্কৃতির অভিব্যক্তির বহির্প্রকাশ। মেলার স্থান মূলত মানুষের আনন্দ-উল্লাস এবং চিত্তবিনোদনের অন্যতম বাহন। বিভিন্ন জেলার লোকজনের সমাগম ঘটে মেলায়। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের গড়াইটুপির অম্রাবতির এ মেলা কবে, কখন, কীভাবে শুরু হয়েছিলো তা সুনির্দিষ্টভাবে কেউ বলতে নাপারলেও প্রবীণজনেরা জানান, শত বছর ধরে কালের সাক্ষী হয়ে ৭ আষাঢ় শুরু হয় এ মেলা। এবছর সরকার মেলার ১০ শতক জমি ইজারা দিয়েছে ৯ লাখ ২৬ হাজার টাকায়। ভ্যাটসহ রাজস্ব আদায় হয়েছে ১১ লাখ ১১ হাজার ২০০ টাকা। গত বছরের চেয়ে এ বছর বেশি রাজস্ব পেয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪ টাকা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে শত বছরের নিয়ম ভেঙে এ বছর ১ আষাঢ় অর্থাৎ আগামী ১৫ জুন রোববার উদ্বোধন হতে পারে এ মেলা। এমনটাই আশা আয়োজকদের। কারণ সামনে রমজান মাস। এদিকে প্রতিবারের ন্যায় মেলাতে এবারও থাকছে সার্কাস, গ্রামবাংলার যাত্রাপালা, পুতুল নাচ, কাঠ-বাঁশ-বেতের দোকান, মিষ্টির দোকান, শিশুদের জন্য বিভিন্ন খেলনাপাতির দোকানসহ আকর্ষণীয় সব আয়োজন। আবার জুয়াড়িদের জন্য থাকছে গভীর রাতের সর্ব প্রকার জুয়ার আসর আর পুতুল নাচের নামে কুরুচিপূর্ণ নৃত্য। মেলানিয়ে অতীতে মেলা কথা শোনা গেলেও মেলার শুরুনিয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত প্রকাশ করে থাকেন। মেলার ইতিহাস নিয়ে এলাকার প্রবীণজনেরা বলেন, জন্ম থেকে আমরা এমেলা দেখে আসছি। বাপ-দাদাদের মুখে শোনা বাংলাদেশ পীর আওলিয়ার দেশ। আর পীর ফকিরদের এদেশের মানুষ শ্রদ্ধা ভক্তি ও সমীহ করে চলে। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে যে পীর ফকিরগণ আল্লাহ প্রেমিক ও মারফতে কামেল বা সিদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী পুরুষ। কাজেই তাদের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। পারস্য থেকে যারা ইসলাম প্রচার করতে এসেছেন তারা সবাই ছিলেন বড় বড় আউলিয়া শিক্ষক, তত্ত্বজ্ঞানী ও ইসলাম প্রচারক। ধর্ম প্রচারকগণ ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে বিভিন্ন বাঁধার সম্মুখিন হতেন। এমনকি বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত হন। যারা মৃত্যুবরণ করেন তাদেরকে ঘিরে গড়ে ওঠা মসজিদ, কবর, বড় বড় মাজার ও আস্তানাগুলো আজও বিখ্যাত হয়ে আছে। বিশ্বাসে মানুষ সে সব জায়গায় করে থাকে মান্নত। তারই ধারাবাহিকতায় চুয়াডাঙ্গা জেলার তিতুদহ ইউনিয়নের নিভৃত পল্লির গড়াইটুপি গ্রামের নির্জন মাঠ মোকামতলায় আস্তানা গড়ে তোলেন খাজা মালিক-উল-গাউস (রঃ)। এ সময় কালোপোলের হিন্দুরাজা গোবিন্দবাবা মালিক শাহর নিকট প্রস্তাব পাঠালেন ধর্ম প্রচার বন্ধ করার জন্য। পাল্টা মালিকশাহ্ ধর্মপ্রচার বন্ধ নয়, বরং আজ থেকে এলাকার মানুষ রাজা গোবিন্দকে যেনো আর খাজনা না দেয় তার হুঁশিয়ারি বার্তা পাঠালেন। ফলে তাদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। গোবিন্দ রাজা প্রস্তাব রাখেন হেরে গেলে আস্তানা ছাড়তে হবে। আর আমার পরাজয় হলে প্রাসাদ ছেড়ে দেয়া হবে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে চুক্তি হয়। গোবিন্দ রাজার কন্যা অম্রাবতী পিতার পরাজয়ের বিষয়টি আচ করতে পেরে কৌশল অবলম্বন করলেন। শর্তমোতাবেক মালিক শাহার বিজয় হয়। মালিক শাহর মৃত্যুর পর তার আস্তানাতেই তাকে কবর দেয়া হয়। কবরকে ইট দিয়ে গেঁথে পাকাকরণ করা হয়। পরে রূপ নেয় মাজারে। প্রবীণেরা আরও জানান, সম্ভবত ১৯৭৮ সালের বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে এলাকায় প্রচণ্ড খরায় মাঠ-ঘাট শুকিয়ে গিয়েছিলো। জেলার অন্যান্য জায়গায় বৃষ্টি হলেও তিতুদহে কোনো বৃষ্টি হচ্ছিলো না। রাতে গায়েবি আওয়াজে গ্রামবাসি জানতে পারে চিত্রা নদীর ধারে একটি পাথর আছে। পাথরটি মাজারের নিকট রাখলে এলাকার মঙ্গল হবে। এলাকাবাসী পাথরটি অনেক খোঁজাখোঁজি করে চিত্রা নদী থেকে পাথর উদ্ধার করে খাজা মালিক-উল-গাউস (রঃ) মাজারে রাখা হয়। বৃষ্টির জন্য এলাকার মানুষ শুরু করে কান্নাকাটি। একপর্যায়ে তিতুদহ ইউনিয়নে আবারও বৃষ্টি শুরু হয়। মাজারের উত্তর দিকে একটি পুকুর আছে সেখানে প্রায় প্রতিদিন মানুষ মনের বাসনা পূরণের জন্য গোসল করে থাকতো পবিত্র হবার জন্য। এদিকে মেলা বসার দিনক্ষণ নিয়ে তর্কবিতর্ক থাকলেও প্রতিবছর ৭ আষাঢ় আসার সময় হলেই তিতুদহ এলাকাবাসীর নিকট বিরাজ করে বাড়তি আমেজ। প্রতিবছর মেলার শুরু থেকে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে কিছুটা মান অভিমান থাকলেও শেষ পর্যন্ত বুড়ো বট বৃক্ষের নিচে বসে মেলা। মেলার এস্থানটিকে কেউ মোকামতলার মেলা, ছোট মেটেরি, ছোটমেটেয়ারি, আমাবতীর কামাই, অম্রাবতীর মেলা, অম্রাবুচি মেলা, অম্রবতীর মেলা নামে উল্লেখ করে থাকেন। কামাইয়ের এমেলাকে সামনে রেখে এলাকার মেয়ের বাবারা তাদের মেয়ে-জামাইকে নিয়ে আসেন নিজ বাড়িতে। মেয়ে থাকবে বাড়িতে আর জামাই ঘুরবে মেলায়। আষাঢ়ের ঝর ঝর বৃষ্টি আর কাদায় মেলার আনন্দে বাড়ির আঙিনা যেনো মুখরিত হয়ে ওঠে। আনন্দ যেনো কোনো কারণে নিরানন্দ না হয়ে যায় মেলা আয়োজকদের নিকট জোর দাবি এলাকাবাসীর। যে পবিত্র মাজারকে কেন্দ্র করে আজ এ মেলা তা কোনো কারণে যেনো অপবিত্র না হয়। মাজারের খাদেম মরজেম হোসেন বলেন, ১৮-১৯ বছর মাজারকে বুকে আকড়ে ধরে পড়ে আছি। শুধু মেলার সময়ই না প্রতিদিনই কেউ না কেউ তাদের মনের বাসনা পূরণের জন্য মান্নত নিয়ে আসে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ১৫ জুন ঐতিহ্যবাহী গড়াইটুপি মেলার উদ্বোধন হবে এমনটাই মনে করছে মেলা আয়োজন কর্তৃপক্ষ।