চীনের এক সড়কে বাংলাদেশ

স্টাফ রিপোর্টার: চীনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিল বাংলাদেশ যা ছিলো প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের মনোযোগের কেন্দ্র। শুক্রবার প্রেসিডেন্ট শি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকের পর স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে চীনের এই উদ্যোগ নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা বলা হয়েছে ওই বৈঠকের পর দেয়া যুক্ত বিবৃতিতে।
চীন-বাংলাদেশের ‘সর্বাত্মক অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ককে’ কৌশলগত অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার’ জায়গায় নিয়ে যেতেও সম্মত হয়েছেন তারা। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সহযোগিতার মতৈক্যা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চীনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে দেখছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর যে লক্ষ্য বাংলাদেশের রয়েছে তা অর্জনে এটা গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ নিয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০১৩ সালে চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগ তুলে ধরেন প্রেসিডেন্ট শি। এরপর থেকে এই উদ্যোগকে ঘিরেই চলছে দেশটির অর্থনৈতিক কূটনীতি। এই উদ্যোগ শুরুর পর থেকে বিদেশে অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে চীন। সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট এবং একুশ শতকের মেরিটাইম সিল্ক রোডকে সংযুক্ত করে নেয়া এই উদ্যোগের আওতায় এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার দেশগুলোকে একটি বাণিজ্য ও অবকাঠামো নেটওয়ার্কে সম্পৃক্ত করতে চাইছে চীন, যার মধ্য দিয়ে কার্যত প্রাচীন সিল্ক রোড রুটকে পুনরায় ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা। উদ্যোগের মূলে অন্যান্য দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের লক্ষ্য রয়েছে।

এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ তৈরিতে বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার বা বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর নিয়েও কাজ করছে বেইজিং।
এই উদ্যোগের পাশাপাশি শিল্পায়নের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিনিয়োগ, সমুদ্র খাত সহযোগিতা (মেরিটাইম কো-অপারেশন), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা এবং সংস্কৃতি ও দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি নিয়ে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে।
চীন-বাংলাদেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা নিয়ে মতৈক্যা হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে সফর বিনিময়ের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম, প্রযুক্তি এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন নিয়ে সহযোগিতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে।
সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের নিন্দা জানিয়েছে উভয় দেশ। সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের পদক্ষেপ এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় সরকারের উদ্যোগে সমর্থন জানিয়েছে চীন। এক্ষেত্রে তথ্য বিনিময়, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশিদের প্রশিক্ষণে সহযোগিতায় প্রস্তুত বলে জানিয়েছে চীন।

সন্ত্রাস দমন নিয়ে সংলাপ অনুষ্ঠানের সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখতে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে, বলা হয়েছে যুক্ত বিবৃতিতে। দুই দেশের জনগণের কল্যাণে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছে চীন ও বাংলাদেশ। এই অঞ্চলের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতেও কাজ করবে দুই দেশ। ‘অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা এবং দুই দেশের মধ্যকার সহযোগিতার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ওপর ভিত্তি করে উভয় পক্ষ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতায় উন্নীতে সম্মত হয়েছে,’ বলা হয়েছে দুই নেতার যুক্ত বিবৃতিতে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, ভালো প্রতিবেশীসুলভ মানসিকতা, পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা ও একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা-এই পাঁচ মূলনীতির প্রতি অবিচল থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে উভয় পক্ষ। এক চীন নীতি এবং দেশটির মৌলিক জাতীয় স্বার্থ, এর সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখ-তা রক্ষায় চীনের পদক্ষেপের প্রতি ঢাকার সমর্থনের প্রশংসা করেছে বেইজিং। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা এবং জাতীয় স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন প্রচেষ্টায়’ সমর্থন দেয়ার জন্য চীনকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। দু পক্ষই উচ্চপর্যায়ে মতবিনিময় বাড়ানো এবং বহু পক্ষীয় ফোরামের সাইডলাইনে দুই দেশের নেতাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার বিষয়ে একমত হয়েছে।
এছাড়া ১৩২০ মেগাওয়াটের পায়রা তাপভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে একাধিক লেনের টানেল নির্মাণ, দাসেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, ছয়টি নৌযান কেনা, পদ্মা সেতু এবং চার স্তরের জাতীয় ডেটা সেন্টার স্থাপনের মতো বেশ কিছু প্রকল্পে অগ্রগতি হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন তারা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সমতা ও উভয় পক্ষের স্বার্থ রক্ষার ভিত্তিতে বিদ্যুত, আইসিটি, নদী ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের ২২টি প্রকল্পে সহযোগিতার প্রস্তাবের বিষয়ে বিবেচনা ও চীনা উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে রাজি হয়েছে চীন। উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা বাড়াতে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি হওয়ায় দুই পক্ষই সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ ও এর উন্নয়নে একযোগে কাজ করতেও সম্মত হয়েছে দুই পক্ষ। ড্রেজিং ও ভূমি পুনরুদ্ধারসহ নদী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সহযোগিতা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়েও একমত হন তারা। এছাড়া চীন-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করবে উভয় পক্ষ। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক জোন ও শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগে দক্ষ চীনা উদ্যোক্তাদের উৎসাহ ও সহযোগিতা দেবে চীন। চীনা উদ্যোক্তারা যাতে বাংলাদেশে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে ঢাকা।
সমুদ্র সম্পর্কিত বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ব্যাপক ক্ষেত্র রয়েছে বলে দুই পক্ষই মনে করে; এ লক্ষ্যে সমুদ্র সম্পর্কিত বিষয়ে সহযোগিতার কৌশল নির্ধারণে সংলাপের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে দুই দেশ। জনপ্রশাসন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিল্পকলার বিভিন্ন বিষয়সহ নানা ক্ষেত্রের বাংলাদেশি পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এবং পেশাজীবীরা যাতে বাংলাদেশেও এ ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে পারেন সে বিষয়ে সহযোগিতা করতে রাজি হয়েছে চীন।
বাংলাদেশের জন্য চীনা ভাষী ৫০০ শিক্ষককে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ১০০ বাংলাদেশি সংস্কৃতি কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেবে বেইজিং। এছাড়া ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৬০০ বাংলাদেশি ছাত্রকে তাদের দেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাবে।
২০১৭ সালকে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ‘বন্ধুত্ব ও আদান-প্রদানের’ বছর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকা ছেড়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট দুদিনের সফর শেষে ঢাকা ছেড়েছেন শি জিনপিং যার এই সফর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উন্নীত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। শুক্রবার সকালে ঢাকায় নামার পর নানা কর্মসূচিতে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে শনিবার সকাল সোয়া ১০টার পর ভারতের গোয়ার উদ্দেশে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়েন চীনের প্রেসিডেন্ট শি।
বিমানবন্দরের ভিভিআইপি টার্মিনালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুলের তোড়া দিয়ে চীনা প্রেসিডেন্টকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানান।

প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের একটি দল চীনা প্রেসিডেন্টকে সামরিক কায়দায় বিদায়ী অভিবাদন জানায়। এরপর লাল লালিচার ওপর দিয়ে চীনা প্রেসিডেন্টকে উড়োজাহাজ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বিদায় জানান শেখ হাসিনা। সকাল ১০টা ২০ মিনিটে চীনের প্রেসিডেন্টকে বহনকারী উড়োজাহাজটি ওড়ার আগে বিমানবাহিনীর চারটি বিমান বিমানবন্দর থেকে ওড়ে। এগুলো বাংলাদেশের আকাশসীমা পর্যন্ত চীনা প্রেসিডেন্টকে পাহারা দেবে বলে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক।
বিমানবন্দরে যাওয়ার আগে সফরের শেষ কর্মসূচিতে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান শি।
স্মৃতিসৌধে চীনের প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানান গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
শি শহীদ বেদীতে ফুল দেয়ার পর স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে একটি গাছের চারা রোপণ এবং পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করেন। লাল গালিচা সংবর্ধনা নিয়ে শুক্রবার সকালে ঢাকায় এসেছিলেন শি। এটি ছিলো তিন দশক পর বাংলাদেশে চীনের কোনো প্রেসিডেন্টের প্রথম সফর। তার এই সফরে বাংলাদেশ-চীন ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছে যার আওতায় বাংলাদেশ চীন থেকে ২১.৫ বিলিয়ন ডলার অর্থ-সহায়তা পেতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ১২টি ঋণ ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি এবং দুই দেশের সরকারের মধ্যে ১৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক বলে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক জানান।