চিনিকল বাঁচাতে কেন্দ্রীয় নিদের্শনা : আখচাষের জমির সন্ধানে সংশ্লিষ্টরা ছুটছেন মাঠে

দর্শনা কেরুজ চিনিকলের শ্রমিক কর্মচারী ও কর্মকর্তারা বদলি আতঙ্কে ॥ সুযোগে সদ্ব্যবহার জমির মালিকদের

নজরুল ইসলাম: আখের ওপর ভিত্তি করে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে গড়ে উঠেছে ১৫টি চিনিশিল্প প্রতিষ্ঠান। চিনিকলের একমাত্র কাঁচামাল হচ্ছে আখ। আখের অভাবে দর্শনা চিনিকলটি পড়েছে সঙ্কটের মধ্যে। তাই চিনিশিল্পকে বাঁচাতে কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছে নানা উদ্যোগ। চাষিদেরকে আখচাষে আগ্রহ সৃষ্টি করতে সকাল বিকেল মাঠকর্মীরা ছুটছেন কৃষকের দ্বারে দ্বারে। চাষিদের কাছ থেকে আশানুরুপ সাড়া না পেয়ে শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক আখ লাগানোর তাগিদ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ছাফ জানানো হয়েছে হয় আখ লাগাও না হয় অন্যমিলে বদলির জন্য প্রস্তুতি নাও। তাই চাকরিজীবীদের মধ্যে বিরাজ করছে বদলি আতঙ্ক। তাই চাকরিজীবীদের অনেকেই চিনিকল এলাকায় আখ লাগানোর জন্য জমির সন্ধানে ছুটছেন। আর সুযোগবুঝে জমির মালিকেরা বাড়িয়ে দিয়েছেন লিজের টাকার অঙ্ক। প্রশ্ন উঠেছে এভাবে কি লক্ষ্যেমাত্রায় পৌঁছানো যাবে?
জানা গেছে, আখের ওপর ভিত্তি করে দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে সরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছে ১৫টি চিনিশিল্প প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছে ২টি। আর চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ৫টি। এদের মধ্যে ১৯৩৮ সালে দৈনিক ১ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলার সীমান্তবর্তী শহর দর্শনায় গড়ে ওঠে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি ভারি কৃষি প্রক্রিয়াকরণ চিনিশিল্প প্রতিষ্ঠান। যেখানে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করতে পারবে। কৃষি পণ্যের মূল্য নিশ্চিত করে কৃষকের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যান্য শিল্প কারখানার সাথে চিনিকলগুলো জাতীয়করণ করেন। আর তখন থেকে অদ্যবদি এটি কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড নামে বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। চিনিশিল্পের একমাত্র কাঁচামাল হচ্ছে আখ। আর এ আখচাষ চিনিকলের নিজস্ব জমির পাশাপাশি মিলজোন এলাকার চাষিরা করে থাকেন। কেরুজ চিনিকলের একটি বীজ উৎপাদন খামারসহ ৯টি বানিজ্যিক খামার রয়েছে। এসব খামারে জমির পরিমান রয়েছে ৩ হাজার ৫৫ দশমিক ৮৪ একর। এর মধ্যে চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমান ২ হাজার ৪০৮ একর। আখ চাষের জমি আছে ২ হাজার ৩৪০ একর। ২০১৬-১৭ রোপন মরসুমে চিনিকলের নিজস্ব জমিতে আখ চাষ হয়েছে ১ হাজার ৭৫০ একর জমিতে। আর চাষিরা আখচাষ করেছে ৩ হাজার ৮৯৬ একর জমিতে। ২০১৬-১৭ রোপাণ মরসুমে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিলো সাড়ে ১২ হাজার একর জমি। একাধিকবার মিটিং করে আখচাষ হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৬৪৬ একর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রার চাইতে ৬ হাজার ৪০৪ একর জমি আখচাষ কম হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্ধেকেরও কম অর্জিত হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার কারণ হিসেবে জানা গেছে, আখচাষ একটি দীর্ঘ মেয়াদি ফসল। ১৮ মাস পর রোপণকৃত জমি থেকে আখ কেটে চিনিকলে সরবরাহ করা হয়। তারপর বিক্রিত অর্থের মুখ দেখে চাষিরা। অথচ ১৮ মাসে জমিতে আখের পরিবর্তে একাধিক ফসল চাষ করে আখচাষের চাইতে বেশি মুনাফা অর্জন করে কৃষকেরা। ছোটসলুয়া গ্রামের আখচাষি আব্দুল্লাহ আল মামুন বললেন, বিঘা প্রতি ৮-৯ হাজার টাকার জমি ১৪ হাজার টাকা করে লিজ নিয়ে ২ একর আখ লাগিয়েছি। জমির মালিকেরা সুযোগ বুঝে জমির দাম হাকিয়েছে। মাধবখালি গ্রামের চাষি সাইফুল ইসলাম বললেন, ২৫ থেকে ২৮ বিঘা করে জমি আখ লাগাতাম। আখ তোলার সময় সিডিএরা আমাদের মানুষ মনে করে না। তাই আখ লাগানো বন্ধ করে দিয়েছি। উজলপুর গ্রামের চাষি নজরুল ইসলাম বললেন, আগে ২ একর করে আখ লাগাতাম এখন আড়াই বিঘা আছে। চিনিকলের লোকজন চাষিদের চেনে না। যারা মিলের পুর্জিতে আখ ফেলে সেখানে আখ ফেলতে আমাদের অতিরিক্ত টাকা লাগে। আমাদের দেয় তো ৫০ পয়সা বেশি। তার পরও বলবো করপোরেশনের জনৈক কর্মকর্তা মিটিং করে মাইক দিয়ে চাষিদেরকে শাসিয়েছে। তারপর থেকেই তো আখচাষ হ্রাস পেয়েছে। তিনার কথাগুলো ছিলো অনেটা নীলকরদের ভাষার মতো। কর্তৃপক্ষের মিল গেটের চাষিদের প্রতি নজর দেয়া দরকার। এমন টানাপোড়নের মধ্যে চিনিকলের বিদায়ী এবং বর্তমানে কতিপয় কর্মকর্তার অসদআচরণের কারণে আখচাষ আরও হুমকির মধ্যে পড়েছে বলে সচেতন মহল মনে করছে। আর এ অবস্থা থেকে উত্তরণ হতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখের দামবৃদ্ধিসহ প্রচুর অর্থ ব্যায় করে চাষিদের আখ লাগানোর ব্যাপারে আগ্রহী করার প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাতে খুব একটা সাড়া মেলেনি। বাস্তবিক কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলে সচেতন মহল মনে করছেন।
একটি সূত্র জানিয়েছে, শেষমেশ উপায়ান্ত না পেয়ে নীতিনির্ধারকরা চিনিকলের সকল শ্রমিক কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের আখচাষ বাধ্যতামূলক করেছেন। সেই সাথে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে ২ হাজার একরের মতো জমি। এমন সিদ্ধান্তে শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকেই মন্তব্য করে বলেছেন, এ যেনো ইংরেজ শাসন আমলের নীলচাষের নির্দেশনার মতো। এদিকে অনেক কর্মকর্তা কর্মচারীর নিজস্ব জমি নেই। তাহলে তারা কি করবে ? পাবলিকের জজিম লিজ নিবে? বর্তমান অবস্থানে দু বছরের জন্য এক একর জমি লিজ নিতে কমপক্ষে ৭২ হাজার থেকে ৮৪ হাজার টাকা লাগবে। যদিও চিনিকর কর্তৃপক্ষ পিএফ ফা- থেকে লোন দেয়ার কথা বলছে। লোন যে নেবে পরিষোধ তো তাকেই করতে হবে। কারণ আখ হচ্ছে ১৮ মাসের ফসল। আর জমি লিজ হয় ১২ মাসের (১ বৈশেখ থেকে ৩ চৈত্র) জন্য। সে হিসেবে আখচাষ করতে হলে ওই কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে ১৮ মাসের জায়গায় ২৪ মাসের জন্য জমির লিজের টাকা দিতে হবে। এর পর বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ, পরিচর্যা, কাটা সর্বশেষ পরিবহন খরচ। তারপর লাভ লোকশানের হিসেব। আর যাদের এক আধটু জমি আছে তারা না হয় জোড়াতালি দিয়ে নির্দেশ পালন করার চেষ্টা করবে। আর যারা এ জেলার বাসিন্দা না তারা কি করবেন? চিনিকল কর্তৃপক্ষের এহন সিদ্ধন্তে অনেকেরই মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। সিদ্ধান্তের পর থেকে আখ লাগানোর জমির সন্ধানে চিনিকলের সকলেই ছুটছেন মাঠে মাঠে। আর এ সুযোগে জমির মালিকেরা বিঘাপ্রতি লিজের টাকা ২ থেকে ৩ হাজার বাড়িয়ে দিয়েছে। অপর একটি সূত্র বলেছে, অতীতে ভোগান্তির কারণে আখচাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে চাষিরা। আখচাষ ছেড়ে অন্যান্য ফসল চাষ করে বেশি মুনাফা অর্জন হওয়ায় নতুন করে আখচাষে ফিরতে চাইছে না চাষিরা। অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে যে সমস্থ সিডিএ আছেন তারা ঠিকমতো চাষিদের সাথে যোগাযোগ করে না। যার কারণে চাষিদের সাথে তাদের সম্পর্কের দূরত্ব বেড়েছে। সিডিএদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হলেও তা পূরণে ব্যর্থ হলে তাদের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ তেমন কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। অনেক সিডিএ আছেন যারা চাষিদের সাথে দেখা করার নাম করে ব্যক্তিগত কাজ করে থাকেন।
আখচাষি কল্যাণ সংস্থার সভাপতি আব্দুল হান্নান এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারি বিশ্বাস বললেন, চাষিদের ঢলতার ১৬-১৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ, কতিপয় ব্যক্তির রক্তচক্ষু এবং চাষিদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার কারণে আখচাষ কমে গেছে। যারা বড় বড় কথা বলে তাদের কতোটুকু আখ আছে। আখচাষ শীতাতপ ঘরে বসে কাগজ কলমের হিসাব নিকাশ না। আখচাষ করতে চাষিদের কতোটুকু ঘাম ঝরাতে হয় তা শুধু চাষিরাই জানে। চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এনায়েত হোসেন বলেন, আখ না লাগালে অন্যত্রে বদলি বিষয়টি এমন না। তিনি আরও বলেন, আগে এর চেয়ে আখ উৎপাদন বিভাগে অনেক লোক কম ছিলো তখন এর চেয়ে অনেক বেশি আখচাষ হয়েছে এখন হবে না কেন? আন্তরিক হলে এ জনবল দিয়েই হবে। আমরা নিজেরা কয়েকজন মিলে ১০ বিঘা জমিতে আখ লাগিয়েছি। চেষ্টা করছি না হলে তো কিছু করার নেই। তারপরও বলবো প্রতিষ্ঠনের স্বার্থে আখচাষ করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।