চিঠি চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

 

মিয়ানমারের মন্ত্রী আসছেন ১১ এপ্রিল : বাংলাদেশ-ইউএনএইচসিআর স্মারক সই ১৩ এপ্রিল

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া এখনও চিঠি চালাচালিতে সীমাবদ্ধ। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া খুবই মন্থর হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের অনীহা, রাখাইন রাজ্যে তাদের নিজবাড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা না করা এবং আন্তর্জাতিক চাপ কমে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে চলতি মাসেই মিয়ানমারের এক মন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসছেন। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ ছাড়াও বর্ষা মরসুম শুরুর ফলে পাহাড় ধসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কায় রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করাকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এখন পর্যন্ত বাস্তবিক কোনো অগ্রগতি নেই। বৃহস্পতিবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব সলিল শেঠী গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী এই অভিমত ব্যক্ত করেন। জানতে চাইলে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসনবিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম শুক্রবার বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। আমরা এখনও চিঠি চালাচালিই করছি। বাস্তবিক কোনো অগ্রগতি নেই।’ তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।

মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বসতি স্থাপনবিষয়কমন্ত্রী উইন মিয়াত আইয়ে ১১ এপ্রিল তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে আসছেন। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র শুক্রবার যুগান্তরকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশ সফরকালে তিনি কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করবেন। মিয়ানমারের মন্ত্রী হিসেবে তিনিই প্রথম রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করবেন। সূত্রটি আরও জানায়, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে ১৬ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের কাছে ৮ হাজার ৩২ জনের পরিবারভিত্তিক তালিকা হস্তান্তর করেছে। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে মিয়ানমার ৫৫৬ জনের একটি তালিকা বাংলাদেশকে দিয়েছে। বাছাই করা এই রোহিঙ্গারা চাইলে মিয়ানমারে ফিরতে পারে। তবে কবে নাগাদ তাদের প্রত্যাবাসন শুরু হবে, তার কোনো দিনক্ষণ কেউ জানাতে পারেনি।

অপরদিকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর লজিস্টিক সহায়তার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ইউএনএইচসিআরের মধ্যে ১৩ এপ্রিল একটি এমওইউ সই হতে যাচ্ছে। জেনেভায় বাংলাদেশের পক্ষে এমওইউ সই করবেন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক এবং ইউএনএইচসিআরের পক্ষে সংস্থাটির প্রধান ফিলিপো গ্র্যান্ডি। ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে বাংলাদেশ জানুয়ারিতেও একটি এমওইউ সই করেছে। ওই এমওইউয়ের আওতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিবারভিত্তিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে ইউএনএইচসিআর। পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, ‘ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে জেনেভায় ১৩ এপ্রিল এমওইউ সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমওইউয়ের আওতায় প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত সহযোগিতা পাওয়া যাবে।’ সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অনেক দিন ধরেই এমন একটি এমওইউ সই করার আলোচনা চলছে। শেষ পর্যন্ত ইউএনএইচসিআরের খসড়ার ওপর বাংলাদেশ সরকারের পর্যবেক্ষণ মোতাবেক পর্যালোচনা শেষ করে এমওইউ সই করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রত্যাবাসনপ্রত্যাশী রোহিঙ্গাদের ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখা, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, তারপর অস্থায়ী ক্যাম্পে থাকা ইত্যাদি মাঠপর্যায়ে প্রত্যাবাসনের লম্বা প্রক্রিয়ার সবকিছুই এই স্মারকে থাকছে। ১৯৯২ সালেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সময়ে ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে বাংলাদেশের এমন একটি চুক্তি হয়েছিলো।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো রাখাইন রাজ্যে তাদের নিজবাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। নিজবাড়িতে ফিরে যাওয়ার আগে তাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে থাকার কথা রয়েছে। রাখাইনে এসব ক্যাম্প তৈরিতে চীন ও ভারত সহায়তা দেয়ার কথা। তবে রোহিঙ্গাদের গ্রাম ও বাড়ি পুনর্গঠন হয়ে গেলে তাদের নিজ বাড়িতে ফিরিয়ে নেয়ার কথাও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলছে। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ সব অধিকার ফিরিয়ে দিতে কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে মিয়ানমার অঙ্গীকার করলেও এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তাদের আন্তরিকতার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর স্থায়ী প্রতিনিধিরা শিগগিরই মিয়ানমার সফর করবেন। তাদের গ্রহণে মিয়ানমার রাজি হলেও রাখাইনে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। তবে এই সফরের সুযোগে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি নিকি হিলি বাংলাদেশ সফরও করবেন। বিশেষ করে তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে যেতে পারেন। মে মাসে ঢাকায় ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা ওআইসি দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৫তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যু অগ্রাধিকার লাভ করবে। ৫৭-জাতির জোট ওআইসি’র পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যেতে পারেন।

গত বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী ঢল শুরু হয়। জাতিগত নির্মূলের লক্ষ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উগ্রপন্থীরা রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করে। নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা, তাদের বাড়িঘরে আগুন, নারীদের ধর্ষণসহ নানাভাবে চলে এই নিষ্ঠুরতা। ওই সময়ে শুরু হওয়া ঢলে এখন পর্যন্ত সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া আগে থেকেই তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছে। বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে গত বছরের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি সই করে মিয়ানমার। ওই চুক্তি মাঠপর্যায়ে প্রয়োগের লক্ষ্যে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চুক্তি সই করে উভয় দেশ। তারপরও এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গাকেই মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ২০০৫ সালের পর একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।