চাল সংগ্রহ নিয়ে ফের বিপাকে সরকার

স্টাফ রিপোর্টার: তিন টাকা বাড়িয়ে প্রতি কেজি সেদ্ধ আমন চালের দর ৩৯ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হলেও বাজারে বেশি দাম থাকায় সরকারের ঘরে ধান-চাল বিক্রি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না চাতাল ও মিল মালিকরা বরং তারা কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে নানা কৌশলে তা গুদামজাত করার চেষ্টা করছেন। এ সুযোগে সরকারের কালো তালিকাভুক্ত অধিকাংশ মিলার অতি মুনাফা লাভের কারসাজিতে মেতে ওঠায় চালের বাজারের লাগাম ফের সরকারের হাতছাড়া হচ্ছে। পাশাপাশি গড় মৌসুমে চালের দর আরও বাড়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। যা সরকারের জনসমর্থনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।

বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, সরকারি গুদামে চালের মজুদ এখনো তলানিতে, আমদানিতেও কোনো সুখবর নেই। এতে এমনিতেই সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়েছে। এর উপর আমন সংগ্রহ অভিযানও যেভাবে ব্যর্থতার দিকে এগোচ্ছে তাতে চালের বাজার সহসা স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনা সরকারের পক্ষে কঠিন হবে। তাই এ ব্যাপারে সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়ানোরও পরামর্শ দেন বাজার বিশ্লেষকরা।

দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, চালের বাজারের উত্তাপ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকরা দীর্ঘদিন ধরে উদ্বিগ্ন। সংকট সমাধানে ইতোপূর্বে ভিন্নমুখী কৌশলও গ্রহণ করা হয়েছে। তবে বাজার সিন্ডিকেটের কারণে এসব উদ্যোগ বরাবরই ভেস্তে গেছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার সব দিক সামলে কঠোর ভূমিকা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, সংগ্রহ অভিযান সফল করতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নজরদারি আওতায় এনে আমদানিকারক, মজুদদার, মিল ও চাতাল মালিকদের প্রকৃত মজুদের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্ব অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কেউ নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি ধান-চাল গুদামজাত করে ভুল তথ্য দিলে লাইসেন্স বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়।

অন্যদিকে গড় মরসুমে বেশি দামে চাল আমদানি করা হলে দেশীয় বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে- এ আশঙ্কা মাথায় রেখে রফতানিকারক দেশগুলোতে চালের দর আরও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আগে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এর আমদানি কীভাবে বাড়ানো যায় তার কৌশলও খুঁজছে সরকার। তবে সরকারের এসব উদ্যোগ কতখানি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন খোদ খাদ্য অধিদফতরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। একাধিক জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ডিসি ফুড) জানান, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হলেও তাতে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। চারা সংকট, অতিরিক্ত দাম এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এবার কৃষকদের আমন আবদ করতে অন্য সময়ের চেয়ে অনেকটা বেশি খরচ হয়েছে। সরকারের ঘরে ফসল বিক্রি করে তাদের পোষাচ্ছে না। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে এ সংকট প্রবল। সেখানকার এক-তৃতীয়াংশ মিলার খাদ্য অফিসের সঙ্গে চাল দিতে চুক্তিবদ্ধ হয়নি। ছোট ছোট মিলারদের লোকসানে খাদ্যগুদামে চাল দিতে বাধ্য করা হলেও রাঘববোয়ালরা অধিকাংশই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। সেখানে ১ লাখ ২৬ হাজার ১৯৭ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও নির্ধারিত সময়ে তার এক-তৃতীয়াংশ সংগৃহীত হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে এবার উত্তরাঞ্চলে সরকারের যে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা অর্জিত হবে না বলে মনে করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের জন্য গত ৭ ডিসেম্বর থেকে কার্যক্রম শুরু হয়ে চলবে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। অথচ এ সময়ে সরকারি সংগ্রহমূল্যের চেয়ে খোলাবাজারে ধান-চালের দর অনেকটাই বেশি থাকবে। তাই সামর্থ্যবান কৃষকরা বেশকিছু ধান-চাল নিজের গুদামে রাখার চেষ্টা করবেন। তবে ঋণগ্রস্তরা তাদের উৎপাদিত ফসলের সিংহভাগই বিক্রি করতে বাধ্য হবেন। যা মিল ও চাতাল মালিকদের হাত ঘুরে সরকারের ঘরে জমা না হয়ে তাদের গুদামে মজুদ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে খুলনা বিভাগের একজন খাদ্য নিয়ন্ত্রক বলেন, চলতি মরসুমে দেশে যে পরিমাণ আমন ধান উৎপাদিত হয়েছে তাতে বাজারে চালের দর ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কোনো কারণ নেই। শুধুমাত্র সরকারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ঊর্ধ্বতন এ খাদ্য কর্মকর্তা জানান, চাতাল ও মিল মালিকরা নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে কতটা বেশি ধান-চাল গুদামজাত করছে তার সঠিক তথ্য তারা সংগ্রহ করতে পারছে না। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হলেও তার কোনোটাই বেশিদূর এগোয়নি। গতানুগতিক যে নিয়মে তাদের মজুদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে তাতে বড় ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরাও এ ব্যাপারে একমত পোষণ করে জানান, মিল ও চাতাল মালিক, মজুদদার, আমদানিকারকদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের গুদামের প্রকৃত মজুদ তথ্য জানা গেলে সরকারের পক্ষে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ হবে। পাশাপাশি বাজার সিন্ডিকেট বড় ধরনের কোনো কারসাজি করতে স্বাভাবিকভাবেই ভয় পাবে বলে মনে করেন তারা। এদিকে চালের অবৈধ মজুদ সংকট ঠেকাতে গত ৩০ অক্টোবরের মধ্যে ফুড গ্রেইন লাইসেন্স বা খাদ্যশস্য লাইসেন্স নেয়া বাধ্যতামূলক করা হলেও সারাদেশে এখনো প্রায় ৪৫ শতাংশ আমদানিকারক, পাইকারি আড়তদার, মিলার ও খুচরা ব্যবসায়ী এর বাইরে রয়েছে। চট্টগ্রামে ৬০ শতাংশ আমদানিকারক, ২৫ শতাংশ আড়তদার এবং ১০ শতাংশ রাইচ মিল এখনো লাইসেন্সের আওতায় আসেনি। এছাড়া খুচরা ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশও ফুড লাইসেন্স নেয়নি বলে জানান মাঠপর্যায়ের খাদ্য কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ১৫ দিন পরপর মজুদের হিসাব দেয়ার নির্দেশনাও মানছে না অনেকেই। ফলে দেশে চালের মোট মজুদ কত সে তথ্য অধরাই থেকে যাচ্ছে।
বিষয়টি পরোক্ষভাবে স্বীকার করে চট্টগ্রাম জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক জানান, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সবাই লাইসেন্স না নেয়ায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এ বছরের ডিসেম্বর ৩১ তারিখ পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস থেকে আমদানিকারকদের তালিকা নিয়ে ৩০ জন আমদানিকারককে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। তবে আরও ৬০ শতাংশ আমদানিকারক এখনো লাইসেন্সের আওতায় আসেনি। এছাড়া ১০ শতাংশ রাইস মিল মালিক এখনো লাইসেন্স নেয়নি।
উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ অঞ্চলের কৃষকরা ধান কাটা শুরু থেকেই বাজারে ধান বিক্রি করছে। বর্তমানে অধিকাংশ কৃষকের ঘরে ধান নেই। তা রাঘববোয়াল মিলার এবং স্টক ব্যবসায়ীদের হাতে গুদামজাত হয়ে আছে। দেশের হাওর অঞ্চলের দুর্যোগকে পুঁজি করে অসাধু মিলার এবং স্টক ব্যবসায়ীরা সেই ধান চাল তৈরি করে উচ্চমূল্যে বাজারে ছাড়ছে। এতে রাতারাতি হাতেগোনা কিছু ব্যবসায়ী হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে বাজার সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অসাধু ব্যক্তিরা দেশের মানুষকে জিম্মি করলেও সরকার তাদের কিছু বলছে না। অসাধু স্টক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে আঁতাত আছে। তবে বিভিন্ন মহল থেকে চালের বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরির জন্য মিলারদের ঘাড়ে দোষ চাপালেও তারা বলেছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, ধানের দাম বেশি এবং সরকারিভাবে বাজার মনিটরিং না থাকায় চালের বাজার অস্বাভাবিক হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের একাধিক হাসকিং চালকল মালিকরা বলছেন, বর্তমান বাজারে মোটা চালে সর্বসাকুল্যে খরচ পড়বে কেজিপ্রতি ৪২ থেকে ৪৪ টাকা। আর সরকার দাম নির্ধারণ করছে ৩৯ টাকা। এতে মিল মালিকদের প্রতি কেজি চালে ৩ থেকে ৫ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই অনেকে সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।