চার মায়ের বুক খালি : বালি খুড়ে ৪ শিশুর লাশ উদ্ধার

স্টাফ রিপোর্টার: মনির মিয়া (৭), জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), তাজেল মিয়া (১০) ও ইসমাইল হোসেন (১০)। সম্পর্কে চার শিশু চাচাতো ভাই। প্রায় প্রতিদিনই একসাথে ওরা খেলতো, আবার একসথেই বাড়ি ফিরতো। তবে গত শুক্রবার ছিলো ব্যতিক্রম। ওই দিন ওরা খেলাধুলা শেষে বাড়ি ফেরেনি। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলে স্বজনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর চার শিশুর সন্ধান না পেয়ে এলাকায় মাইকিং করা হয়। পরদিন পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় সাধারণ ডায়েরিও করা হয়েছিলো। শিশুদের সন্ধানে পুলিশের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। তবে পরিবারের সদস্যরা তখনও জানতেন না, এতো বড় দুঃসংবাদ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। স্বজনরা ভেবেছিলেন, খেলতে খেলতে ওরা পথ হারিয়েছে। কিন্তু না; নিখোঁজ হওয়ার ৫ দিন পর গতকাল বুধবার হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটেকি গ্রামের ঈসাবিলে বালুর স্তূপের ভেতর থেকে চার শিশুর লাশ উদ্ধার করা হলো। দেশের বিভিন্ন এলাকায়
প্রায় প্রতিদিন কোনো না-কোনো মায়ের বুকের নিধি অকালে হারাচ্ছে। এবার বাহুবলে একসাথে খালি হলো চার মায়ের বুক। এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে উপজেলাজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন স্বজনরা। গত বছর সিলেটে শিশু রাজন ও খুলনায় রাকিবকে নৃশংসভাবে হত্যার পর দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। এবার টেলিভিশনের পর্দায় বাহুবলে একসাথে চার শিশুকে হত্যার রোমহর্ষক ঘটনা প্রচার হলে নাড়া দেয় লাখ লাখ মানুষকে। এখন শিশুদের সন্ধানে নয়, খুনিদের সন্ধানে লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করল পুলিশ। হতভাগ্য চার শিশুর মধ্যে আবদুল ওয়াহিদ মিয়ার ছেলে জাকারিয়া শুভ সুন্দ্রাটেকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র, আবদুল আজিজের ছেলে তাজেল মিয়া চতুর্থ শ্রেণি ও আবদাল মিয়ার ছেলে মনির মিয়া প্রথম শ্রেণিতে পড়তো। আর আবদুল কাদিরের ছেলে ইসমাইল মাদরাসায় পড়তো।
গতকাল ময়নাতদন্ত শেষে ডা. দেবাশীষ জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, শিশুদের শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। শিয়াল-কুকুরের কামড়ে দুই শিশুর শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। ওই চার শিশুর পরিবারের সদস্যরা জানান, শুক্রবার স্কুল ও মাদরাসা বন্ধ থাকায় ওরা খাওয়া-দাওয়া শেষে বাড়ি থেকে খেলার উদ্দেশে বের হয়। সন্ধ্যায় বাড়ি না ফিরলে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করা হয়। তাদের সন্ধান না পেয়ে পরদিন শনিবার জাকারিয়া শুভর বাবা ওয়াহিদ মিয়া বাহুবল থানায় একটি জিডি করেন। জিডিতে চার শিশুর নিখোঁজ থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। পুলিশ জিডি পাওয়ার পর দেশের সব থানায় বার্তা পাঠায়। হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র শিশুদের সন্ধানে ২০ হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেন। নৃশংস এ ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে সুন্দ্রাটেকি গ্রামের আবদুল আলী ও তার ছেলে জুয়েলকে রশিদপুর এলাকা থেকে আটক করেছে পুলিশ। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানায়, তিন মাস আগে ওই গ্রামের আবদুল আলীর ছেলে রুবেলের ইভটিজিং করার প্রতিবাদে ফয়েজাবাদ স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা মানববন্ধনের আয়োজন করে। সেখানে হামলা চালায় রুবেলের সাঙ্গপাঙ্গরা। এ নিয়ে গ্রামবাসীর সাথে আবদুল আলীর লোকজনের মারামারি হয়। এদিকে এক মাস আগে স্থানীয় সাজিদ মিয়ার বাড়ির সীমানা নিয়ে জনৈক প্রতিবেশীর মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে আবদুল আলী সালিসের জন্য এগিয়ে যান। সাজিদ মিয়া তাকে পঞ্চায়েতের মুরব্বি না মানায় তার ওপর হামলা করে আবদুল আলী ও তার লোকজন। সাজিদের পক্ষে চার শিশুর স্বজনরা প্রতিবাদ করেছিলেন। এ নিয়ে সংঘর্ষও হয়। এর পর থেকেই আবদুল আলী ও তার লোকজন নানাভাবে ওই চার শিশুর স্বজনকে হুমকি দিয়ে আসছিলেন। পরে উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল হাই বিরোধের মীমাংসা করে দেন। ওই বিরোধকে কেন্দ্র করে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের সাথে আবদুল আলীর পরিবার জড়িত কি-না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তবে লাশ উদ্ধারের পর থেকেই আবদুল আলীর পরিবার গা ঢাকা দিয়েছিলো।

পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র জানান, গত শুক্রবার আবদুল ওয়াহিদ বাহুবল থানায় সন্তান নিখোঁজের ঘটনায় একটি মামলা করলে তা জেলা গোয়েন্দা বিভাগে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই মামলায় কাউকে আসামি করা হয়নি। তিনি ধারণা করছেন, শুক্রবারই খুনিরা শিশুদের হত্যা করে কোনো এক সময় প্রায় দুই ফুট নিচে গর্তে তাদের বালুচাপা দেয়। ঘটনাস্থল থেকে এক জোড়া চামড়ার স্যান্ডেল উদ্ধার করেছে পুলিশ।
সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মিজানুর রহমান বলেন, এটি একটি চরম রোমহর্ষক ঘটনা। দরিদ্র পরিবারগুলোর ওপর এমন নিষ্ঠুরতা দেখে হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। খুনিদের ব্যাপারে যে তথ্য দেবে, তার পরিচয় গোপন রাখা হবে এবং ভবিষ্যত নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাশে থাকবে। বড়দের গ্রাম্য বিরোধ নিয়ে এ ঘটনা ঘটেছে।

গ্রামজুড়ে আহাজারি: চার শিশুর লাশ উদ্ধারের পর নিহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। শোকে কাঁদছে পুরো বাহুবল। সন্তানদের হারিয়ে মা-বাবারা বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। নিহত শুভর বাবা আবদুল ওয়াহিদ বিলাপ করছিলেন আর বলছিলেন, কেন ওরা আমার কলিজার টুকরাকে কেড়ে নিলো? পুলিশ প্রথম থেকে বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি। স্থানীয়রা জানায় গতকাল সকাল ১০টার দিকে ওই গ্রামের এক ব্যক্তি বালুর স্তূপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পচা গন্ধ পান। তিনি বালুর স্তূপের কাছে একটু এগিয়ে দেখেন এক শিশুর ক্ষত-বিক্ষত হাত বের হয়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে তিনি গ্রামের লোকজনকে খবর দিলে হাজারো মানুষ ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। এরই মধ্যে খবর পৌঁছে যায় বাহুবল থানায়। লাশ পাওয়ার খবর পেয়ে ছুটে যান হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র, ৱ্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের সদস্য, ডিবি ও পিআইবির সদস্যরা। বেলা সাড়ে ১১টায় বালু খুঁড়ে চার শিশুর লাশ উদ্ধারের কাজ শুরু হয়। দুপুর পৌনে ১টায় লাশগুলো হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালমর্গে পাঠানো হয়। গতকাল দেশের সবকটি টেলিভিশন চ্যানেলে সারাদিনের প্রধান খবরই ছিলো সুন্দ্রাটেকি গ্রামের চার শিশুর লাশ উদ্ধারের ঘটনা। খবর পেয়ে ছুটে আসেন সিলেটের ডিআইজি মিজানুর রহমান ও হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাবিনা আলম। জেলা প্রশাসক নিহত প্রত্যেক শিশুর পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেয়ার ঘোষণা দেন।