চাই চাই উপজেলা চাই স্লোগানে উত্তাল এলাকা : আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা

হারুন রাজু/হানিফ মণ্ডল: কোনো কিছুর দাবি পূরণের ক্ষেত্রে স্মরণকালের রেকর্ড ভাঙলো দর্শনা তথা দর্শনা এলাকার ৬ ইউনিয়নবাসী। যে কোনো মূল্যে দর্শনাকে উপজেলায় উন্নীত করণের ক্ষেত্রে আন্দোলনের অংশ হিসেবে গতকাল কয়েক হাজার মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিলো তাদের প্রাণের দাবি, দর্শনাকে উপজেলা চাই। মানববন্ধনে অতো মানুষের উপস্থিতি জানিয়ে দিয়েছে দাবি আদায়ে কতোটা আন্তরিক এখন এলাকাবাসী।
দীর্ঘদিন ধরেই দর্শনাকে উপজেলায় উন্নীত করার দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে সর্বস্তরের মানুষ। এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। ন্যায্য অধিকার আদায়ে মাঠ ছাড়তে নারাজ আন্দোলনকারীরা। উপজেলাকরণ আন্দোলনে এখন সর্বস্তরের মানুষ হয়েছে সোচ্চার। দলমত নির্বিশেষে সবাই দাঁড়িয়েছে এক কাতারে। এ দাবি আদায়ে সব ধরনের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত এলাকাবাসী। সরকার দাবি পূরণ না করা পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে দর্শনাকে উপজেলা আন্দোলন মঞ্চের নেতৃবৃন্দ। দেড়শ বছরের পুরোনো শহর দর্শনার ভৌগলিকভাবে সীমানা খুব দীর্ঘ না হলেও ইতিহাস, ঐতিহাসিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ভূখণ্ড গঠিত হওয়ার পূর্ব থেকেই অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি শহর। ১৯৩৮ সালে এশিয়া মহাদেশের ২য় বৃহত্তর ও দেশের সর্ববৃহৎ কেরুজ চিনিকল দর্শনায় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ভিত আরো মজবুত হয়। দর্শনায় কাস্টমস স্থাপিত হয় ১৯৫৮ সালে। পরপরই ইমিগ্রেশনের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর প্রথম বাংলাদেশের ভূখণ্ডে দর্শনা থেকে জগতি পর্যন্ত ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়। সেই থেকে দর্শনা জংশন দেশের বুকে আলাদা একটা মহিমা নিয়ে পরিচিতি লাভ করতে থাকে। দর্শনায় দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক রেলপথ যার মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের আগে ভারতের সাথে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয় দর্শনা স্টেশন থেকে। বর্তমানে যা দর্শনা আর্ন্তজাতিক রেলস্টেশন নামে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় দর্শনার ভূমিকা ইতিহাসের মানচিত্রে আজও সমাদৃত। মুক্তিযুদ্ধের সময় টেলিফোন বা টেলিগ্রাফে দর্শনার কোর্ড (ছদ্মনাম) ছিলো উওঘএঅ। যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে পারাপার ও প্রশিক্ষণের ট্রানজিট পয়েন্ট ছিলো দর্শনা। তাছাড়া মহান মুক্তিদ্ধুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ গৌরবময় ভূমিকা ছিলো এ শহরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। সরকারের কোষাগারে রাজস্ব দেয়ার দিক থেকেও দর্শনা অনেক এগিয়ে। কেরুজ চিনিকল, ডিস্টিলারি বিভাগ, রেলস্টেশন, কাস্টমস, ব্যাংক, বীমা, ইমিগ্রেশনসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর সরকার প্রায় ৩শ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়ে থাকে। দর্শনার সাংস্কৃতিক পরিচয় আজও দেশব্যাপী সুনাম অর্জন করছে। দর্শনার এক সময়ের প্রশাসনিক পরিচয় ছিলো ইউনিয়ন যা ১৯৯১ সালে পৌরসভায় রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে দর্শনা পৌরসভা ২য় শ্রেণির মর্যাদাপ্রাপ্ত। রাজনৈতিকভাবেও দর্শনার অবস্থান বেশ মজবুত। চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য হাজি আলী আজগার টগর, চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিষদের প্রসাশক মাহফুজুর রহমান মঞ্জুসহ বিভিন্ন দলের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের বসবাস দর্শনায়। পারকৃষ্ণপুর-মদনা, কুড়ুলগাছি, বেগমপুর, নেহালপুর, গড়াইটুপি ও তিতুদহ ইউনিয়ন নিয়ে দর্শনাকে উপজেলায় উন্নীত করণের ক্ষেত্রে সকলের রয়েছে আন্তরিক মনোভাব। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ফেসবুকে দর্শনা উপজেলা আন্দোলন নামে একটি ফেসবুক আইডি দর্শনাকে উপজেলার করণের দাবির আন্দোলনের ঝড় তুলেছে। অব্যাহত আন্দোলনের অংশ হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার ছাত্র সমাজের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশাল মানববন্ধন কর্মসূচি। প্রায় ৫ কিলোমিটার পথজুড়ে মানববন্ধন কর্মসূচিত অংশ গ্রহনকারী সর্বস্থরের মানুষের সংখ্যা অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙেছে। দর্শনাকে উপজেলা আন্দোলন মঞ্চের সার্বিক তত্বাবধানে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে দর্শনা হল্টস্টেশন থেকে মেমনগর মোড় পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার সড়কে ছিলো চোখে পড়া মতো মানুষের উপস্থিতি। দর্শনা রেলবাজার, বাসস্ট্যান্ড ও পুরাতন বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেয় ব্যবসায়ীরা। এছাড়া অংশ নিয়েছে সবকটি রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শ্রমিক ও পেশাজীবি সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মানববন্ধন কর্মসূচিকে আরো বেগবান করেছে দর্শনা পৌরসভাসহ ৬টি ইউনিয়নের কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সকাল সাড়ে সাড়ে ১০টার দিকে একযোগে জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে কর্মসূচির সূচনা করা হয়েছে। প্রায় ১ ঘন্টাব্যাপী মানববন্ধন চলাকালীন ৪টি পয়েন্টে উন্মুক্ত আলোচনা মঞ্চে সংহতি প্রকাশ করে আলোচনা করেন নেতৃবৃন্দ। উন্মুক্ত আলোচনাকালে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য হাজি আলী আজগার টগর বলেছেন, দর্শনা আমার প্রাণের শহর। এ শহর উপজেলায় উন্নীত হোক এ দাবি আমারও। ইতোমধ্যেই পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রকে পূর্ণাঙ্গ থানায় উন্নীত করণের কাজ শেষের দিকে পৌঁছেছে। আন্দোলনকারীদের সাথে একমত পোষণ করে এমপি টগর সব ধরণের সহযোগিতাসহ দর্শনাকে উপজেলা করবেই বলে সংহতি প্রকাশ করেছেন। চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিষদের প্রশাসক মাহফুজুর রহমান মনজু বলেছেন, দর্শনা অনেক আগেই উপজেলা হওয়ার উচিত ছিলো। রাজনৈতিক ব্যর্থতায় তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে এখন সময় এসেছে আমাদের প্রাণের দাবি পূরণের। দর্শনাকে উপজেলায় উন্নীত করণের ক্ষেতে সব ধরণের সহযোগীতার কথা বলে সংহতি প্রকাশ করেছেন মনজু। সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা আনোয়ারুল ইসলাম বাবু বলেছেন, উপজেলার দাবিতে আজ জেগেছে এলাকাবাসী। এ আন্দোলন সফল হবেই হবে। দর্শনা উপজেলায় উন্নীত হবে এটাই আমার চাওয়া। দর্শনা পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান বলেছেন, দর্শনা আমার অহঙ্কার, আমার গর্ব। দর্শনা উপজেলা হোক এ আমার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। এ স্বপ্ন পূরণে আমরা আজ একসাথে মাঠে নেমেছি। সংহতি প্রকাশ করে আলোচনা করেন, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অবসরপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেন, অ্যাড শহিদুল ইসলাম, দর্শনা পৌর মেয়র মহিদুল ইসলাম, পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউপি চেয়ারম্যান জাকারিয়া আলম, সাবেক চেয়ারম্যান খাজা আবুল হাসনাত, বেগমপুর ইউপি চেয়ারম্যান আলী হোসেন, সাবেক চেয়ারম্যান আহম্মদ আলী, কেরুজ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি তৈয়ব আলী, সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান, সাবেক সভাপতি হাফিজুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম প্রিন্স, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম, সাবু তরফদার, জাহাঙ্গীর আলম লুল্লু, হাজি আকমত আলী, হাজি খালেকুজ্জামান, আ. বারী, আলী মুনসুর বাবু, গোলাম ফারুক আরিফ, কবি ও সাহিত্যিক আবু সুফিয়ান, সিরাজুল ইসলাম, শফিকুল আলম, দর্শনা রেলবাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাবির হোসেন মিকা, পুরাতন বাজার দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আশরাফুল আলম বাবু, সাইফুল ইসলাম সোহেল, বাসস্ট্যান্ড ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হায়দার আলী, সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন আহম্মেদ সান্টু, মোজাহারুল ইসলাম, মুক্তি ক্লিনিকের পরিচালক ডা. রফিকুল ইসলাম, শিক্ষক প্রতিনিধি আরতি হালসনা, হারুন অর রশিদ জুয়েল, অনির্বানের সভাপতি ফজলুল হক, সাবেক ছাত্রনেতা জামাল উদ্দিন, হারুন অর রশিদ, রামাযুসের সভাপতি আবু ফয়সাল, ছাত্রসমাজের ব্রাইট, ছাত্রনেতা আলামীনের সভাপতিত্বে সংহতি প্রকাশ শেষে দর্শনাকে উপজেলা আন্দোলন মঞ্চের মুখপত্র আনোয়ার হোসেন আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা দেন।