চাঁদাবাজ বিজয়-বিকাশের অব্যাহত অপতৎপরতায় দিশেহারা চুয়াডাঙ্গার ইটভাটা মালিকরা

স্টাফ রিপোর্টার: চাঁদাবাজদের অব্যাহত হুমকিধামকিসহ হামলায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চুয়াডাঙ্গার ইটভাটা মালিকেরা। পুলিশও নাকাল। দেশি সেলফোনের পর চাঁদাবাজরা এখন ভারতীয় সিম ব্যবহার করে খুন-গুম বোমা মারার হুমকি দিচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরের অধিকাংশ সীমান্তে বাংলাদেশ অভ্যন্তরেও ভারতীয় মোবাইলফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। এই সুযোগটিই কাজে লাগিয়ে চাঁদাবাজচক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
দামুড়হুদা এলাকার ইটভাটায় মাঝে মধ্যে হানা দিয়ে শ্রমিকদের তুলে নিচ্ছে মাঠে। নির্যাতন করে চাঁদার টাকা আদায়ের চেষ্টা করছে। প্রতিশ্রুতি পেয়ে ছেড়েও দিচ্ছে। গুঞ্জন রয়েছে, একাধিক চাঁদাবাজ গ্যাঙের কয়েকজন হোতা ভারত সীমান্তে অবস্থান করে। সুযোগ বুঝে দেশে ঢুকে অপরাধমূলক কর্মকা- করে সীমান্তের কথিত ধুরপাচারকারীচক্রের সহযোগিতায় ভারতে ফিরে যায় তারা।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার ৬টি ইটভাটার মালিকদের নিক নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে গণহারে সেলফোনে তথা মোবাইলফোনে ২ লাখ টাকা করে চাঁদা দাবি করা হয়। নিজেকে চরমপন্থি দলের নেতা বিজয় বলে পরিচয় দিয়ে চাঁদার টাকা ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পরিশোধের সময়সীমা বেধে দেয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাঁদার টাকা না দিলে ইটভাটায় বোমা হামলাসহ খুন-গুমের হুমকি দেয়া হয়। মালিকরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। পুলিশ সুপারকে জানানো হয়। গত ২৯ নভেম্বর দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গায় ইটভাটা মালিকসহ এলাকাবাসীকে নিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী সভা করে পুলিশ। সেই সভা থেকে পুলিশ এলাকাবাসীর হাতে লাঠি তুলে দিয়ে সন্ত্রাস প্রতিহত করার আহ্বান জানায়। প্রতিটি ইটভাটায় চাঁদাবাজদের প্রাথমিক হামলা প্রতিহত করার মতো ১০ জন করে পাহারাদার রাখারও তাগিদ দেয়া হয়। বলা হয় সিসি ক্যামেরাও স্থাপন করতে হবে। পুলিশ যেদিন কার্পাসডাঙ্গায় সন্ত্রাসবিরোধী সভা করে, সেদিন রাতেই নতিপোতার মামুনকে অপহরণ করে অস্ত্রধারীরা। রাতারাাতি মুক্তিপণ আদায় করে মুক্তিও দেয় তাকে। অপরদিকে দামুড়হুদা থানা পুলিশ একই রাতে রামনগর কলাবাড়ি ও গোপালপুরের  ৪ জনকে গ্রেফতার করে। এরা হলো- সাইফুল, সোমা, হিরন ও কালু। পুলিশের তরফে বলা হয়, এরা সন্দেহভাজন চাঁদাবাজ। ৪ জনকে গ্রেফতার করা হলেও চাঁদাবাজচক্রের হুমকি বন্ধ হয়নি। বরং বেড়েই চলেছে। অপরদিকে জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া এলাকায় বিকাশ মজুমদার বলে পরিচয় দিয়ে একই কায়দায় ইটভাটা মালিকদের নিকট মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করা হয়। ১ ডিসেম্বর দামুড়হুদা পুলিশ মেহেরপুর গাংনীর কসবা গ্রামের নাহিদ হাসান ও দামুড়হুদা নতিপোতার মতিয়ার রহমানকে গ্রেফতার করে। পুলিশ জানায়, নাহিদ হাসান এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী বুদো ওরফে বিজয়ের নিকটাত্মীয়। বুদোর দাবিকৃত অর্থ নাহিদসহ কয়েকজন আদায় করে বলেও তথ্য পায় পুলিশ। এরই একপর্যায়ে ৬ ডিসেম্বর মেহেরপুুর গাংনীর একটি ইটভাটায় হানা দিয়ে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় তিনজন। এরা হলো- গাংনীর ষোলটাকা গ্রামের তুহিন, মানিকদিয়ার মহিবুল ও তাজুল। তিন চাঁদাবাজের পতন হলেও থামেনি চাঁদাবাজচক্রের হোতা বিজয় ও বিকাশের হুমকিধামকিসহ তার সহযোগীদের অপতৎপরতা। গত ১৪ ডিসেম্বর দামুড়হুদার মোক্তারপুরের ইটভাটায় হানা দিয়ে ৩ জন পোড়াই শ্রমিককে তুলে নিয়ে যায় চাঁদাবাজচক্র। মাঠে নিয়ে নির্যাতন করে। ইটভাটা মালিকের মোবাইলফোনে কথা বলে। সূত্র বলেছে, টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে তিন শ্রমিক জয়রামপুরের রেজাউল, হাউলির হৃদয় ও মকছেদ আহত অবস্থায় মুক্ত হয়ে ভাটায় ফেরেন। এ নিয়ে চুয়াডাঙ্গা ইটভাটা মালিক সমিতি জরুরি বৈঠকে মিলিত হয়। হুইপের সাথে আলোচনা করেন। বৃহত্তর আন্দোলনেরও প্রস্তুতি নেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করে মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ।
এদিকে জীবননগর উপজেলার কিছু ভাটামালিক গোপনে পোড়াই শ্রমিকের মাধ্যমে চাঁদার কিছু টাকা দিলেও নতুন নতুন নামে নতুন করে চাঁদাদাবি করা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। আলমডাঙ্গা উপজেলার বেশ কিছু ইটভাটা মালিক গোপনে কিছু চাঁদা পরিশোধ করেছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। তবে এর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
কে এই বিজয়? পুলিশসূত্র বলেছে, বিজয় বলে পরিচয় দেয়া ব্যক্তিই হলো গাংনী কসবার বুদো। ধুরন্দর প্রকৃতির মধ্যবয়সী বুদোকে দীর্ঘদিন ধরে র‌্যাব-পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজলেও ভারত সীমান্তে ঘাঁপটি মেরে থাকার কারণে টিকি ছোঁয়া যাচ্ছে না। দেশের মোবাইলফোন নম্বর দিয়ে প্রথমে চাঁদাবাজি করলেও পরবর্তীতে ভারতীয় সিম ব্যবহার করছে। ফলে তার অবস্থান সম্পর্কে প্রযুক্তিগত তথ্য পেতে সমস্যা হচ্ছে। এছাড়াও দামুড়হুদা চারুলিয়ার জামু, মেহেরপুর সোনাপুরের সাদ্দাম, নতিপোতার বিল্লাল, হক সাহেব, সেলিম ও নাটুদা বোয়ালমারীর বুদোর গড়ে তোলা পৃথক গ্যাঙ গ্রুপের অপতৎপরতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এদের মধ্যেও কয়েকজন ভারতসীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান করে বলে একাধিকসূত্রে তথ্য পাওয়া গেছে।
চুয়াডাঙ্গার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার বেলায়েত হোসেন বলেছেন, ইতোমধ্যেই সন্দেহবাজন ১০ চাঁদাবাজকে ধরে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তাছাড়া ইটভাটা মালিকদের নিজ নিজ ভাটায় নিজস্ব প্রাথমিক নিরাপত্তা বেষ্টনি গড়ে তোলার জন্য জানানো হয়েছে। সিসি ক্যামরাও স্থাপন করতে অনুরোধ জানিয়েছি। কিন্তু সেদিকে ইটভাটা মালিকদের আন্তরিক হতে দেখছি না। পক্ষান্তরে চুয়াডাঙ্গা জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোতালেব বলেছেন, ইটভাটায় প্রতিদিন ১০ জন করে পাহারাদার রাখা কি সম্ভব? তাতে কতো টাকা খরচ হয় সেটা কি ভেবে দেখেছেন? ইটভাটা তো আর শহরের মধ্যে নয়, জনবিচ্ছিন্ন এলাকাতেই করতে হয়। সেখানে সিসি ক্যামরা লাগালে তারই বা নিরাপত্তা কোথায়। লাখ লাখ টাকা দিয়ে সিসিক্যামেরা লাগালে সিসি ক্যামেরার কি নিরাপত্তা পুলিশ দিতে পারবে? তখনও এখনকার মতোই বলবে, ভাটাই তো আর পুলিশ সার্বক্ষণিক রাখা সম্ভব নয়। সিসি ক্যামেরার দায়িত্বও তো ভাটা মালিককে নিতে হবে! ইটভাটা মালিকদেরই শুধু নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বহু গ্যাঙ গজে উঠেছে। অধিকাংশেরই টার্গেট হুমকি দিয়ে অর্থ আদায়। প্রতিকার চায় এলাকাবাসী।