চলে গেলেন বর্ষীয়ান নেতা মীর্জা সুলতান রাজা

আজ সকাল ৯টায় জীবননগরে ১০টায় দর্শনায় ও ১১টায় চুয়াডাঙ্গায় জানাজা

 

স্টাফ রিপোর্টার: বর্ষীয়ান নেতা মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মীর্জা সুলতান রাজা ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহে…. রাজেউন)। গতকাল রোববার ঢাকা খিলগাঁওস্থ বাসা থেকে হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৭৬ বছর। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে চুয়াডাঙ্গার সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। ঢাকার বাসায় আওয়ামী লীগ-বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই তাকে শেষবারের মতো এক নজর দেখার জন্য ছুটে যান।

বাদ মাগরিব খিলগাঁওয়ে প্রথম দফা নামাজে জানাজার পর গতরাতেই লাশ চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশে নেয়া হয়। আজ সোমবার সকাল ৯টায় জীবননগর কেন্দ্রীয় ঈদগা ময়দানে নামাজে জানাজা শেষে মরদেহ নেয়া হবে দর্শনা কেরুজ মাঠে। ১০টায় তৃতীয় দফা জানাজা শেষে চুয়াডাঙ্গা টাউন ফুটবল মাঠে মরদেহ নেয়া হবে। এখানেই গার্ড অব অনার প্রদানের পর বেলা ১১টায় ৪র্থ দফা জানাজা শেষে চুয়াডাঙ্গা জান্নাতুল মাওলা কবরস্থানে মা-বাবার কবরের পাশেই বর্ষীয়ান এ নেতাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে। মৃত্যুকালে মীর্জা সুলতান রাজা স্ত্রী, দু ছেলে ও তিন কন্যাসহ বহুগুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে অসংখ্য ব্যক্তি শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।

Mirz Sultan Raja

চুয়াডাঙ্গা শেখপাড়ার মীর্জা মঞ্জিলের মরহুম মীর্জা ময়েজ উদ্দীন আহম্মেদের বড় ছেলে মীর্জা সুলতান রাজা জাসদ কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করাকালে ১৯৮৩ সালে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। পরে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন। নির্বাচনের পর থেকেই নানা রোগে আক্রান্ত হন। ঢাকার বাসায় পড়ে মীর্জা রাজা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর থেকে একটানা চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। মীর্জা সুলতান রাজার আদিবাড়ি দামুড়হুদা দর্শনার ছয়ঘরিয়া গ্রামে। অসুস্থ অবস্থায় তিনি অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন ঢাকা খিলগাঁওয়ের বাসায়। মীর্জা সুলতান রাজার সহোদর বীরমুক্তিযোদ্ধো মীর্জা শাহরিয়ার মাহমুদ লন্টু জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থতার কারণে বড় ভাই রাজাকে ঢাকার বেশ কয়েকটি হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসাধীন রাখা হয়। এর মধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, কেয়ার হাসপাতাল এ সেন্ট্রাল হাসপাতাল অন্যতম। গত কোরবানির ঈদেরদিন রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। গত ১১ নভেম্বর বাড়ি ফেরানোর পর বেশ ভালোই ছিলেন। গতকাল রোববার দুপুরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তড়িঘড়ি তাকে হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি। বেলা ২টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মীর্জা সুলতান রাজার মৃত্যুর খবরে শোক নেমে আসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যেও। কেন্দ্রীয় নেতা তোফায়েল আহম্মেদ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি, চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান দুদু, জেএসডির চুয়াডাঙ্গা সেক্রেটারি কেন্দ্রীয় নেতা তৌহিদ হোসেন, মেহেরপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা প্রফেসর আব্দুল মান্নান, দামুড়হুদা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মঞ্জুসহ অসংখ্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মরহুমকে শেষবারের মতো দেখার জন্য তার ঢাকা খিলগাঁওয়ের বাসায় ছুটে যান। বাদ মাগরিব প্রথম দফা নামাজে জানাজায় শরিক হন তারা।

মীর্জা সুলতান রাজা মহান মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ৫ ভাইয়ের মধ্যে ৪ ভাইই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মীর্জা সুলতান রাজা বড়। বীরমুক্তিযোদ্ধা মীর্জা সাঈদ মাহামুদ দ্বিতীয়, বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর্জা সোহরাব মাহমুদ তৃতীয়, মীর্জা শাহরিয়ার মাহমুদ লন্টু ৪র্থ ও মীর্জা শাহাজাহান মাহমুদ ছোট। মীর্জা সুলতান রাজার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দেশ তথা জাতির জন্য বহু অবদান রেখেছেন। তিনি ১৯৩৭ সলের ৪ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর থানার গোয়ালহুদা গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে চুয়াডাঙ্গা ভিজে উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সক্রিয় কর্মী হিসেবে অবদান রাখেন। ১৯৫৫ সালে জগন্নাথ কলেজে আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। একই বছরে ৯২এর ক’ ধারা অমান্য করে ২১ ফেব্রয়ারি শহীদ দিবস পালন করেন। মীর্জা সুলতান রাজা ১৯৬৫ সালে পটুয়াখালীর আমতলী থানার ঘূর্ণিঝড়ের পর রিলিফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চুয়াডাঙ্গায় ফেরেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সংগঠক হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীনতার পর মীর্জা সুলতান রাজা শ্রমিকলীগের চুয়াডাঙ্গা শাখা গড়ে তোলেন। কেন্দ্রীয় সদস্য মনোনীত হন। ১৯৭২ সালে জাসদে যোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি হন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে গ্রেফতার হয়ে হাজতবাস করেন। ছয়মাস পর মুক্ত হন। জাসদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন। ১৯৮০ সাল থেকে ৮২ সাল পর্যন্ত গণকণ্ঠের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে এশিয়া-আফ্রিকা সংহতি পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে রাশিয়া সফর করেন। ১৯৮৬ সালে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হন। জাসদ ভেঙে গেলে তিনি ১৯৯০ সালে জনতা মুক্তিপার্টি গংগঠিত করে সভাপতি হন। ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগে একত্রীভুত হন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর্জা সুলতান রাজার মৃত্যুতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখা শোক জানিয়েছে। শোকবার্তায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের অন্যতম সদস চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর্জা সুলতান রাজার মৃত্যুতে গভীর দুঃখ ও শোক প্রকাশ করেছেন চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন, সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদুল ইসলাম আজাদ। নেতৃবৃন্দ বলেছেন, মীর্জা সুলতান রাজা ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সৈনিক। তার এই মৃত্যুতে চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ সমগ্র জাতি হরালো একজন প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক নেতাকে। তার এই শূন্যতা অপূরণীয়। চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগ মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছে। তার শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। পৃথক শোক বার্তায় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চুয়াডাঙ্গা জেলা ইউনিট কমান্ডের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম চুয়াডাঙ্গা জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে শোক জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মীর্জা সুলতান রাজার মৃত্যুতে চুয়াডাঙ্গা জেলার সকল মুক্তযোদ্ধাগণ গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর অভাব কোনভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। একই সাথে আজ বেলা ১১টায় টাউন ফুটবল মাঠে মরহুমের প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার প্রদান করা হবে। পরে নামাজে জানাজা সম্পন্ন করা হবে। নামাজে জানাজা ও দাফন কাজে সকলকে অংশ নেয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি। পৃথক শোক বার্তায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা হাফিজুল ইসলাম লাল্টুসহ অসংখ্য ব্যক্তি শোক জানিয়ে মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছেন।

            দর্শনা অফিস জানিয়েছে, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তার শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য হাজি আলী আজগার টগর, চুয়াডাঙ্গা জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক, দামুড়হুদা উপজেলা,চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদুল ইসলাম আজাদ, দামুড়হুদা উপজেলা আ.লীগের সভাপতি সিরাজুল আলম ঝন্টু, সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মঞ্জু, যুগ্মসম্পাদক ইউপি চেয়ারম্যান জাকারিয়া আলম, সাংগঠনিক সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম, দর্শনা পৌর আ.লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র মতিয়ার রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী, রুস্তম আলী, দর্শনা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব গোলাম ফারুক আরিফ, দর্শনা রেলবাজার কমিটির সভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক সাবির হোসেন মিকা, দামুড়হুদা উপজেলা জাসদের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম লুল্লু, দর্শনা পৌর জাসদের সভাপতি হাজি হারুন অর রশিদ প্রমুখ।

জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, মীর্জা সুলতান রাজার মৃত্যুতে জীবননগর উপজেলা চেয়ারম্যান জীবননগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মোর্তূজা, যুগ্মসম্পাদক প্রভাষক মো. নজরুল ইসলাম, জীবননগর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু মো. আব্দুল লতিফ অমল, সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন, জীবননগর প্রেসক্লাব সভাপতি আনোয়ারুল কবির, জীবননগর বাজার কমিটির আহ্বায়ক বিশিষ্ট সাংবাদিক মুন্সী মাহবুবুর রহমান বাবু, প্রেসক্লাব সেক্রেটারি আতিয়ার রহমান, সালাউদ্দীন কাজল, আকিমুল ইসলাম, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী রেনুকা আক্তার ও রানি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।