ঘাতকচক্রের সদস্য মোমিন গ্রেফতার : হত্যামামলাটি চাঞ্চল্যকর মামলার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি

 

সাংবাদিক সদরুল নিপুল হত্যার প্রতিবাদে প্রতিবাদপদযাত্রা বিক্ষোভে রূপান্তর : আজ সরোজগঞ্জে সাংবাদিক-জনতার প্রতিবাদ সমাবেশ

 

স্টাফ রিপোর্টার: মোমিনপুর স্টেশন এলাকার স্বঘোষিত নৈশপ্রহরী মোমিনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সে রেলওয়ের জমি দখল করে জেনারেটর ব্যবসার পাশাপাশি এলাকার মাদকচক্রের আশ্রয়দাতা হিসেবে চিহ্নিত। সাংবাদিক সদরুল নিপুল হত্যার সাথে মোমিনের সংশ্লিষ্টতার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েই গতকাল তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। একই সাথে রিমান্ডের আবেদন জানিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কমকর্তা জিআরপি দর্শনা ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মোনায়েম। গ্রেফতারকৃত মোমিন আমিরপুর হঠাতপাড়ার শামসুল হকের ছেলে। ওই মোমিনই সন্ধ্যার পর সদরুল নিপুলকে মোটরসাইকেলযোগে চুয়াডাঙ্গায় নেয়। পরে মাদকের আখড়ায় নিতে সহায়তা করে।

সাংবাদিক সদরুল নিপুল হত্যা মামলাটি চুয়াডাঙ্গা জেলার রোমহর্ষক চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক সমিতি চুয়াডাঙ্গা জেলা ইউনিটের আহ্বানে প্রতিবাদপদযাত্রা শেষে পেশকৃত স্মারকলিপিতে এ দাবি জানানো হয়। অপরদিকে নীলমণিগঞ্জসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার সাধারণ মানুষ সাংবাদিক নিপুল হত্যার প্রতিবাদে লাগাতার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গতকাল বিকেলে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। মানববন্ধন বিক্ষোভ মিছিলে রূপ নেয়। বিক্ষোভ শেষে সমাবেশে বক্তারা সাংবাদিক সদরুল নিপুল হত্যাকারীদের কেউ পার পাবে না মন্তব্য করে বলেছেন, সাংবাদিক সদরুল নিপুলকে পরিকল্পিতভাবে ডেকে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর মুমূর্ষু অবস্থায় রেললাইনের মধ্যে ফেলে দিয়েছে যারা তাদের পরিচয় এলাকাবাসীর কাছে আর অজানা নেই। পুলিশও জানে। দ্রুত সময়ের মধ্যে পুলিশ ঘাতকচক্রের সদস্যদের ধরতে না পারলে এলাকাবাসী উচিত শিক্ষা দিতে বাধ্য হবে। সাংবাদিক হত্যার প্রতিবাদে আজ সোমবার বিকেল ৪টায় সরোজগঞ্জ বাজার কমিটি ও আঞ্চলিক সাংবাদিক ইউনিটের উদ্যোগে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এ সমাবেশে সকলকে অংশ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

সাংবাদিক সদরুল নিপুল হত্যার প্রতিবাদে ও হত্যাকারীদের গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক সমিতি চুয়াডাঙ্গা জেলা ইউনিট তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। প্রথম দফায় ঘোষিত তিন দিনের কর্মসূচির সমাপনী দিনে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় প্রতিবাদপদযাত্রা বের করা হয়। প্রতিবাদপদযাত্রায় শুধু সাংবাদিক নয়, জেলার সুশীল সমাজ, জনপ্রতিনিধিদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বিক্ষোভে রূপ নেয়। গণপ্রতাজতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পেশ করা হয়। স্মারকলিপি গ্রহণ করেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আঞ্জুমান আরা। তিনি স্মারকলিপি গ্রহণকালে বলেন, সাংবাদিক সদরুল নিপুল হত্যাকাণ্ডে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন মর্মাহত। অবশ্যই প্রশাসনের তরফে আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সকল প্রকারের পদক্ষেপ নেয়া হবে। চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কমিটি নিশ্চয় যথাযথ সিদ্ধান্ত নেবে। তাছাড়া স্মারকলিপিটি যতো দ্রুত সম্ভব যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট পৌঁছে দেয়া হবে। স্মারকলিপির অনুলিপি প্রদান করা হয় চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপারের নিকট। স্মারকলিপি গ্রহণ করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছালেহ আহমেদ। তিনি স্মারকলিপি গ্রহণকালে চুয়াডাঙ্গার সকাল সাংবাদিকের নিরাপত্তার বিষয়টির কথা উল্লেখ করে বলেন, সাংবাদিক সদরুল নিপুল হত্যা মামলার সন্দেহভাজন একজন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার নিকট থেকে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। বাকি আসামিদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে। সদরুল নিপুল হত্যার সাথে জড়িত কেউ পার পাবে না। সে যতো বড় গডফাদারই হোক, আর যেই হোক। যেহেতু মামলাটি জিআরপি পুলিশের আওতাভুক্ত, তবুও সদর থানা পুলিশকে ছায়া তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তদন্ত চলছে। সেই তদন্তেই বেরিয়ে এসেছে মোমিনপুর স্টেশনের মাদকচক্রের হোতাদের নামধাম।

স্মারকলিপি পেশকালে চুয়াডাঙ্গার সাংবাদিকদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন- চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন। তিনি জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে সাংবাদিক সদরুল নিপুল হত্যার সাথে জড়িত সকলকে দ্রুত গ্রেফতার করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, সদরুল নিপুল ছিলেন দায়িত্বশীল একজন সাংবাদিক। সাংবাদিকতার কারণেই তাকে চিহ্নিত একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। হত্যার পর ঘটনা ভিন্নখাতে নেয়ার জন্য নিথর দেহ রেললাইনের মাঝে ফেলে রাখে। কারা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে তা স্থানীয়দের কাছে যেমন পরিষ্কার তেমনই পুলিশ প্রশাসনের কাছেও পরিষ্কার। হত্যাকারী সে যেই হোক, তাকে দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে। চুয়াডাঙ্গায় কর্মরত সকল সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

তথ্যমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি জেলার অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট পেশপূর্বে পাঠ করেন সাংবাদিক ইসলাম রকিব। স্মারকলিপির অনুলিপি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গ্রহণের পূর্বে তা পাঠ করেন সাংবাদিক জেড আলম। চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব সেক্রেটারি সরদার আল আমিন ও সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহার আলী স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি পেশকালে চুয়াডাঙ্গায় কর্মরত সাংবাদিকদের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন চুয়াডাঙ্গা চেম্বার সভাপতি ইয়াকুব হোসনে মালিক, পরিচালক শাহারিন হক মালিক, দাতা সদস্য জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা তৌহিদ হোসেন প্রমুখ।

অপরদিকে সাংবাদিক সদরুল নিপুল হত্যার প্রতিবাদ ও হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে গতকাল রোববার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মোমিনপুর ইউনিয়নবাসী ও নীলমণিগঞ্জ বাজার কমিটির দেয়া ৩ দিনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রতিবাদ মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। ওই কর্মসূচিতে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। সকল পেশার মানুষের স্বতঃফূর্ত অংশগ্রহণই প্রমাণ করে সাংবাদিক নিপুল ছিলো সবার প্রিয় মানুষ। প্রতিবাদসভায় বক্তারা বলেন, সাংবাদিক সদরুল নিপুলকে কারা হত্যা করেছে তা এখন পুলিশ ও জনগণের কাছে পরিষ্কার। সন্দেহজনক আসামিরা এখনো বাজারে ঘোরাফেরা করছে। আজ সোমবার সন্ধ্যার মধ্যে যদি আসামিদের অভিভাবকেরা নিজ উদ্যোগে তাদের মাদকাসক্ত সন্তানদের আইনের হাতে সোপর্দ না করে, তাহলে অভিভাবকদেরও অবস্থা হবে ভয়াবহ। বক্তারা আরো বলেন, সাংবাদিক সদরুল নিপুল হত্যার আসামিদের অভিভাবকরা অনেক নেতা ধরে বেড়াচ্ছেন। সেই সকল অভিভাবকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বক্তারা বলেন, কোনো নেতা ধরে কাজ হবেনা। সাংবাদিক সদরুল নিপুল হত্যার বিচার এই চুয়াডাঙ্গার মাটিতে হবেই হবে।

মোমিনপুর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দার এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেন। আগামী মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব থেকে প্রতিবাদ মিছিল সহকারে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হবে বলে জানান। তবে ইতোমধ্যে এলাকাবাসীর উদ্যোগে মোমিনপুর স্টেশনের প্লাটফর্মের দুপাশের অবৈধ সকল দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে জনতা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফেস্টুন, ব্যানার ও প্লেকার্ড নিয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। এরপর একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করা হয়। প্রতিবাদ মিছিলটি পিটিআই মোড় থেকে মোমিনপুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে আবার মোমিনপুর বাজারের রেলস্টেশনে গিয়ে সমাবেশে পরিণত হয়। প্রতিবাদসভায় সভাপতিত্ব করেন মোমিনপুর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দার।বক্তব্য রাখেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মান্নান বিশ্বাস নান্নু, নীলমণিগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান, নীলমণিগঞ্জ বাজার কমিটির সাবেক সভাপতি হেলাল উদ্দিন বিশ্বাস, নীলমণিগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খালিদ হাসান মিলন, বাজার কমিটির সভাপতি মেম্বার মোস্তাফিজুর রহমান নিপুল, সেক্রেটারি সাজু মিয়া, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান মাজু, হাটব্যবসায়ী, বিএনপি নেতা শিখন প্রমুখ।উপস্থিত ছিলেন- সাংবাদিক অনিক সাইফুল, হুসাইন মালিক, বন্ধু ব্লাড গ্রুপের আতিকুর রহমান মাসুম, আক্তার হোসেন, রাসেল আহম্মেদ, শাহ আব্দুল খালেকসহ এলাকার ব্যক্তিবর্গ।

উল্লেখ্য, চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের নীলমণিগঞ্জের মরহুম নূর মোহাম্মদের ছেলে সদরুল নিপুল ছিলেন দৈনিক মাথাভাঙ্গার মোমিনপুর ইউনিয়ন প্রতিনিধি। গত ২০ মে রাতে তাকে তার বাড়ির অদূরবর্তী মোমিনপুর রেলস্টেশনে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে স্থানীয় একটি মাদকচক্র। নির্যাতনের পর মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে দেয় রেললাইনের ওপর। পরদিন ট্রেনে কাটা ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে জিআরপি। হত্যাকাণ্ড ভিন্নখাতে নেয়ার জন্য রেললাইনের মধ্যে ফেলে রাখলেও ঘাতকচক্রের নির্যাতনে রক্তাক্ত সদরুল নিপুলের রক্ত প্লাটফর্মে থাকার কারণে হত্যার বিষয়টি আর আড়াল করতে পারেনি তারা। যে ইট দিয়ে সদরুল নিপুলের মাথায় আঘাত করা হয় সেই ইটও উদ্ধার করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।